আরিফুল ইসলাম
বিয়ের পরে ঘর গুছানোর পালা। বিয়ে উপলক্ষ্যে বন্ধু-বান্ধবের দেওয়া উপহারে ঘরের একাংশ মোটামুটি ভর্তি। ইহান আর লাফিজা মিলে উপহারগুলো গুছাচ্ছে।
বিয়ের উপহার হিসেবে বেশ কিছু বইও এসেছে। তাছাড়া জায়নামাজ, আতঁর, কোরআনের বেশ কিছু অনুবাদও এসেছে। সবকিছু জায়গামতো গুছিয়ে রাখার পর লাফিজার চোখ গেলো র্যাপিং পেপার দিয়ে বাঁধানো একটা বোর্ডের দিকে। ইহানও আগ্রহভরে লাফিজার র্যাপিং পেপার খুলা দেখলো, ভেতরে কি আছে সেটা দেখার জন্য।
উপহারটা পাঠিয়েছে রিফাত, ইহানের বন্ধু। র্যাপিং পেপার খোলার পর তারা দেখতে পেলো এটা একটা Wish Board। অনেক সময় কোনো ইচ্ছার কথা বলতে না পারলে লিখে রাখলে যাতে
কেউ দেখে ইচ্ছাপূরণ করে সেজন্য এই উইশ বোর্ড। লাফিজার ও ইচ্ছা ছিলো এরকম একটা উইশ বোর্ড তাদের রুমে থাকবে। ভাগ্যিস সেটা আর কিনতে হয়নি।
লাফিজা ইহানকে বলে দিলো ইহানের যদি কোনো ইচ্ছা থাকে, বলতে পারছেনা তাহলে সেটা এই উইশ বোর্ডে লিখে রাখতে। ইহান ইচ্ছা বোর্ডে 'ইচ্ছা'র সাথে আরেকটা বিষয় যোগ করলো, উপদেশ/পরামর্শ। কোনো বিষয়ে যদি পরামর্শ দিতে হয়, কিন্ত মুখে বলতে দ্বিধাবোধ হলে সেটাও যেনো উইশ বোর্ডে লিখে রাখা হয়।
উইশ বোর্ডটা ফোমের। চিরকুট পিন দিয়ে এই ফোমের সাথে যাতে গেঁথে রাখা যায় সেজন্য।
রুমের পূর্বদিকে দেয়াল ঘড়ির নিচে উইশ বোর্ডটা টানানো হলো। এতে করে ঘড়িতে সময় দেখার সাথে সাথে উইশ বোর্ডে নতুন কোনো উইশ যোগ হলে সেটাও দেখতে পারা যায়।
একদিন অফিস থেকে ফিরে ইহান দেখলো উইশ বোর্ডে প্রথম উইশ লিখা। লাফিজার হাতের লেখা যে এতো সুন্দর, ইহান সেটা এর আগে তখনো লক্ষ করেনি। রঙ্গিন কলম দিয়ে সাদা কাগজের উপর সুন্দর হাতে লেখাটা ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে।
একই লেখা বাংলায় এবং ইংরেজিতে দুই ভাষায়ই লেখা। লাফিজার ইংরেজি লেখার চেয়ে বাংলা হাতের লেখাটা বেশি সুন্দর লাগছে।
উইশ বোর্ডের লেখাটা পড়ে মনে মনে একটু হাসলো ইহান। সারাদিন ডিউটি করে অনেকটা টায়ার্ড হয়ে ডিনার করেই শুয়ে পড়লো।
লাফিজার ঘুম অনেক পাতলা। ঘুমের মধ্যে ঘাড় ফেরানোর শব্দেও আগে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো, এখন অবশ্য প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ইহান ঠিক বিপরীত। ছোটবেলায় ইহানের মা মজা করে বলতেন, ঘুমের মধ্যে যদি ইহানকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে কেউ পুকুরে ফেলে দেয়, তবুও ইহান টের পাবেনা।
রাতে গভীর ঘুমে যখন নিমজ্জিত তখন লাফিজা বারবার ইহানকে ডাক দিচ্ছিলো। কখনো চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছে সে।
একপর্যায়ে হাতে করে কয়েক ফোটা পানি এনে ইহানের মুখে ছিটিয়ে দিলো। আকষ্মিক মুখে পানির ঝাপটা পড়ার সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে বসলো ইহান। মুখ থেকে হাত দিয়ে পানি মুছতে মুছতে লাফিজার দিকে তাকালো। লাফিজা মিটিমিটি হাসছে।
'কি হলো' জিজ্ঞেস করার পর উইশ বোর্ডের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে লাফিজা বললো, "রাতে এটা পড়ে ঘুমাও নি?"
পরক্ষণে ইহানের মনে পড়লো, রাতে পড়া এই উইশ বোর্ডের এই লেখাটির কথা।
লেখাটা আবার পড়লো ইহান।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আসসালাম বলেছেন,
"আল্লাহ করুণা করুন ঐ ব্যক্তির উপর, যে রাতে ওঠে সালাত আদায় করে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়; স্ত্রী যদি ওঠতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে হালকা পানির ঝাপটা দেয়।
আল্লাহ করুণা করুন ঐ নারীর প্রতি, যে রাতে ওঠে সালাত আদায় করে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়; স্বামী যদি ওঠতে না চায় তাহলে তার মুখমণ্ডলে পানির ঝাপটা দেয়।" [১]
একই কথা নিচে আবার ইংরেজিতেও লিখা। বেশ কয়েকদিন ধরে ফজরের নামাজ জামা'আতে পড়তে পারেনা ইহান।
আস্তে আস্তে প্রতিদিন রাতে যখন মুখের উপর পানির ঝাপটা পড়া শুরু হলো তখন থেকে আর ফজরের নামাজ জামা'আতে পড়া আর মিস হয়না তার।
লাফিজাকে ঘুমে পেয়ে কোনো একদিন এভাবে মুখের উপর পানির ঝাপটা দিবে সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকলে সেই সুযোগ আর আসছেনা।
প্রায় প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে দেখে লাফিজা তার আগে ঘুম থেকে উঠে নামাজে দাঁড়িয়েছে।
বিয়ের কয়েকদিন পর একবার কেনাকাটা করার জন্য লাফিজাকে নিয়ে গেলো ইহান। তখন প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলো লাফিজা বডি স্প্রে, পারফিউম মেখে এসেছে। কেনাকাটা করার সময় কিছু বললো এটা নিয়ে কিছু বললো না ইহান। বাসায় এসেও কিভাবে বলবে বুঝতে পারছেনা সে।
হঠাৎ চোখ গেলো উইশ বোর্ডের দিকে।
কলম দিয়ে চিরকুটে একটা বাক্য লিখে পিন দিয়ে উইশ বোর্ডে আটকিয়ে রাখলো ইহান।
পরদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার সময় রেডি হলো লাফিজা। ঘর থেকে বের হবার সময় তার প্রিয় Craze পারফিউমের মুখটা যখন খুললো তখন হঠাৎ চোখ গেলো উইশ বোর্ডের দিকে।
পারফিউমের ছিপটা হাতে নিয়ে উইশ বোর্ডের লেখাটা পড়তে গেলো।
লেখাটা পড়ে লাফিজার অবস্থা এমন হলো যেরকমটা সূরা মায়িদার ৯০ নাম্বার আয়াত নাযিল হবার পর সাহাবীদের হয়েছিলো।
মদের পেয়ালা মুখে নিয়ে যখন চুমুক দিতে যাবেন তখন যখন শুনতে পেলেন মদ খাওয়া 'হারাম', তখন যেভাবে তারা হাতের পেয়ালা ছুড়ে ফেলে দেন তেমমি লাফিজাও এই উইশ বোর্ডের লেখাটা পড়ে হাতের পারফিউম মাটিতে ছুড়ে ফেললো আনমনে।
লেখাটা ছিলো এমন,
আবু মুসা আল আশ'আরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
"যে নারী সুগন্ধী (পারফিউম) মেখে পুরুষদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা (পুরুষরা) তার সুগন্ধ পায়, সে নারী ব্যভিচারিণী।" [২]
কাচ ভাঙ্গার শব্দে ইহান রুমে ঢুকলো। রুমটা সুগন্ধে ভরে গেছে। দৌঁড়ে এসে লাফিজার হাত ধরে দেখলো হাত কাটলো কিনা।
যদিও লাফিজার হাত কাটেনি তবুও হাত কাঁপছে!
কাঁপা হাত শক্ত করে ধরে ইহান লাফিজাকে শুনালো,
إِنَّمَا ٱلتَّوْبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُو۟لَٰٓئِكَ يَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا
The repentance accepted by Allah is only for those who do wrong in ignorance [or carelessness] and then repent soon after. It is those to whom Allah will turn in forgiveness, and Allah is ever Knowing and Wise.
অর্থঃ অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভূলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।
রেফারেন্স :
১। আবু দাউদ: ১৩০৮, সুনানে নাসাঈ: ১৬১০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৩৬, রিয়াদুস সালেহীন: ১১৮৩।
২। সুনানে নাসাঈ: ৫১২৬, জামে আত তিরমিযী: ২৭৮৬।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন