একটি সন্ধ্যা রাতের গল্প
আবু সুফিয়ান
হিমেল যখন অামাকে গল্পটি বলছে, তখন অামার কায়ায় রাজ্যের ক্লান্তি। অাকাশে অাষাঢ়ি-মেঘের মেলা। অামি খোলা জানালায় চোখ মেলে মেঘেদের ছুটাছুটি দেখছি। সন্ধ্যা তখনো ঘনায়নি। হিমেল বলে উঠলো, ''পিয়ার ভাই, বৃষ্টিকে অামি অার ফিরে পাইনি।''
''হিমেল, এক্ষুণি মনে হয় বৃষ্টি অাসবে। দেখেছ, অাষাঢ়ি মেঘ ধরে কীভাবে অন্ধকার নামছে?'' কথাটা শুনে হিমেল বিরক্তির চোখে অামার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অামি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করলাম, 'বৃষ্টিকে ফিরে পাওনি কেন?' উত্তরে সে বলল, ''অভিমান তাকে ফিরতে দেয়নি।''
বাহিরে তখন হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমেছে। হিমেল জানালার দিকে এগিয়ে এসে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। ক্ষণিক নিরবতা কাটিয়ে সে বলে উঠলো, ''জানেন পিয়ার ভাই, এমনি এক বর্ষাতে তার সাথে অামার পরিচয়। তখন প্রচণ্ড ঝুম বৃষ্টি। জনশূন্য শহরের অলিগলি, রাস্তা-ঘাট সব বৃষ্টি বুকে নিয়ে থৈ-থৈ খেলছে। জানালার পাশে বসে লিখতে থাকা অামার গল্পের শহরে তখন বৃষ্টি নেই। গ্রীষ্মের কড়া রোদ্দুর চলছে। সেই কড়া রোদ্দুর গায়ে মেখে শহরের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির গল্প লিখছিলাম অামি। হঠাৎ করেই বারান্দায় মায়ের সাথে কাউকে যেন কথা বলতে শুনি। হ্যাঁ'রে হিমেল শুনছিস, এদিকে অায় তো বাবা! মায়ের ডাকে তড়িৎ সাড়া দিতে অামি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। মা বলে উঠলেন, ''মেয়েটি বৃষ্টিতে অাটকা পড়েছে। পাশের কলোনিতেই ওদের বাসা। ছাতা করে এগিয়ে দিয়ে অায়।''
ঘর থেকে ছাতা এনে মেয়েটির মাথায় মেলে ধরে অামি তাকে সম্বোধন করে বললাম, ''ভেজা কাকের গল্প শুনেছেন কখনো?'' উঠোন ভর্তি পানিতে মেয়েটি ছলাৎ শব্দে পা রেখে বলে উঠলো, ''অামার নিঃসঙ্গতার চার দেয়ালে কোনো গল্পকার নেই।'' তার মুখশ্রীতে তখন বৃষ্টির ছিঁটা পড়ে একটা ফ্যাকাসে অবয়ব তৈরি হয়েছে। অামি তার সাথে পদ মিলাতে-মিলাতে বললাম, ''অামি একটা গল্প বলতে চাই, শুনবেন?'' উত্তরে সে নিচুস্বরে 'হু' বলে সম্মতি জ্ঞাপন করল।
-
বিষণ্ন মধ্যাহ্ন। গ্রীষ্মের কড়া রোদ্দুর। শহরের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি। যার মুখশ্রী ভরা বিষণ্নতার লেপন; যেন কোনো দীর্ঘশ্বাসের ছায়া। এই মধ্যাহ্নটা তার কাছে হয়তো কোনো অভিশপ্ততা; কিংবা বেঁচে থাকার কোনো সংকল্পতা। কে জানে, এই মেয়েটিরও সুখ রাজ্যের একটি গল্প ছিল। এই তো, বছর দেড় পূর্বের কথা। সুমন প্রথম যেদিন মেয়েটিকে দেখেছে, সেদিন তাকে ঘিরে সুমনের কোনো অনুভূতিই ছিল না। অথচ, মেয়েটির জোড়াচোখে সেদিন ভরা কামুকতার ইশারা ছিল। তার বাল্যবন্ধু রাজন দু'গাল হেসে তাকে পাশ কেটে মেয়েটিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে দরজায় খিল টানে। যদিও সেটা তার কাছে নিতান্তই একটা টেলিস্কোপিক দৃশ্য ছিল। রাজনের সাথে বাজিতে হেরে যে তাকে এমন নিষিদ্ধপল্লি কিংবা এমন দৃশ্য দেখতে হবে, সেটা কে জানতো! তবে সুমনের মুহূর্তেই মনে হলো, এই অাসাটা একেবারেই মন্দ হয়নি। কারণ, মেয়েটির শেষের দৃষ্টিটি তাকে অন্য কিছু বুঝিয়েছিল। সুমন মনে মনে ভেবে নিয়েছে, 'বাজিতে এবার রাজনের সাথে জিততেই হবে।' কারণ, মেয়েটির দৃষ্টিটি তাকে অারো গভীর ভাবে বুঝে নিতে হবে।
-
মেয়েটির সাথে সুমনের যেদিন দ্বিতীয় সাক্ষাত হয়েছে, সেদিনও রাজন তার সঙ্গে ছিল। তবে সুমন সেদিন বাজিতে জিতে এসেছিল। প্রথমবারের সেই শেষ দৃষ্টিটি দ্বিতীয়বার বারকয়েক দেখেছিল মেয়েটির অাঁখি জোড়ায়। সুমন দ্রবীভূত হয়েছে তাতে। দুজনের মাঝে বিনিময় হয়েছিল এক চিলতে সঙ্গী হওয়ার হাসি। যাতে ভরাডুবি ছিল এক রাজ্য সুখ। সুমন সেদিন মেয়েটির নাম দিয়েছিল, 'হৈমি।' অার মেয়েটি বলেছিল, অাত্মীয় সমাজে তার নাম 'হিমাদ্রী।' তবে তার অনুরোধ ছিল, তাকে যেন সুমন, হৈমি নামেই ডাকে। এতে সে নিজেকে নতুন করে চিনবে, জানবে। নতুন পরিচয়ে বেড়ে তুলবে জীবনের বাকি সময়। ঠিক মাধবীলতার মতো। নতুন ভাবে, নতুন কোনো জায়গায়। সুমনের 'অাচ্ছা, ডাকব' বলে কথা দেয়ার পর থেকে দু'জন হয়ে উঠে দু'জনের অর্ধছায়া। দুজনের মাঝে প্রহর শেষে নিঃশব্দ পদে সন্ধ্যা নামে। শিশিরের মতো মৃদু শব্দ করে, অাপন সুখে রোদের গন্ধ মুছে যায় দু'জন। তারা ভেঙ্গে ফেলে পৃথিবীর সব জড়তা। নামিয়ে নেয় নিজেদের মত করে এক অপার্থিব রং। পৃথিবীর সব অালো তখন তাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। অার রাত জাগা তক্ষককে সাক্ষী রেখে অায়োজন করে নতুন গল্পের পাণ্ডুলিপি।
-
বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে একদিন খুব করে বৃষ্টি নামে। সেদিন তাদের সম্পর্কের একবছর পূর্ণ হয়েছে। দুজনই পার্কের বেঞ্চে বসে বৃষ্টি নামার ছন্দ দেখছিল। হৈমি দু'হাত মেলে বৃষ্টি টুপটুপ-বৃষ্টি টুপটুপ বলে মুঠো ভরে বৃষ্টির পানি নিয়ে সুমনের মুঠোয় পুরিয়ে দিচ্ছে। সুমন সেই বৃষ্টির পানিগুলো অযত্নে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। তখন হৈমি বায়না ধরে বলে উঠলো, ''সুমন, অামি চাই কেউ অামার সবকিছুকে অযত্নে নয়; বরং খুব যত্ন করে ধরে রাখুক। পরম ভালোবাসা দিয়ে পাশে রাখুক অামৃত্যু।'' সুমন ঈষৎ তাচ্ছিল্যে হেসে বলে উঠলো, ''সে 'কেউ' কি তুমি খুঁজে পেয়েছ, নাকি খুঁজতে চাচ্ছ?'' সুমনের কথায় হৈমি যেন অাশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছে। তড়িৎশিখা জ্বলে উঠে তার চিত্তে। এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার ঘোরে কাটে। পরক্ষণে হৈমি যখন বুঝতে পেরেছে সুমন তার পাশে নেই, তখন বৃষ্টির সাথে-সাথে যেন হু-হু করে কালবৈশাখীর ঝড় ঘিরে ফেলেছে তার চারধার। অামি কি ভুল বাসনা করেছি, নাকি ভুল মানুষ চিনেছি? নিজ প্রশ্নের উত্তর পেতে হৈমি যখন চারধারে চোখ বুলাল সুমনের খোঁজে, তখন বেঞ্চ মাঝে দেখতে পায় একটি চিরকুট। বৃষ্টির ঝিরঝির ফোটা চিরকুটের উপর খসখস শব্দ করে যাচ্ছে। হৈমি কম্পিত লোচনে চিরকুটের লেখায় দৃষ্টি রাখলো...
প্রিয় হৈমি,
অামার স্যাঁতসেঁতে জীবনে তুমি যে ভালোবাসার উষ্ণতা নিয়ে এসেছিলে, তাতে অামার হৃদয় মমে ভারি বসন্ত জেগেছিল। পরিচয়হীন বাল্যকাল থেকে অবহেলা, অবজ্ঞায় বেড়ে উঠা এই অামি নিজের নামটাও যেখানে স্পষ্ট জানতাম না, সেখানে কালেভদ্রেও কারোর পরম উষ্ণতা পাওয়া তো নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছিল। অথচ তুমি সেটা দিয়েছ। কিন্তু, কুকুরের পেটে ঘী হজম না হওয়ার মতো, তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে অামার মাঝে বাসা বাঁধে এক মৃত্যুপুরীর গল্প। জগতে পরিচয়হীনতার সাথে-সাথে অাত্মার পরিচয়টাও ক্ষণে-ক্ষণে মুছে নিচ্ছে মরণব্যাধি ক্যান্সারে। ভালোবাসার ঘোরে পড়ে অামি বেমালুম ভুলেই বসেছিলাম খুব বেশি দেরি নয় অামার জীবনের শেষ স্টেশন। সেই স্টেশনে পৌঁছে তোমার থেকে বিদায় নেয়ার শক্তি, সাহস কোনোটাই অামার নেই বলেই, অাজ এই অপ্রত্যাশিত বিদায়। এই চিরকুট পড়ে তুমি যখন অামার খোঁজে নেমে পড়বে, তখন খুব অচেনা কোথাও নিঃশব্দে পড়ে থেকে তোমার পদ-ধ্বনি শুনবো। বিদায় হৈমি বিদায়...।
ইতি
সুমন
-
বৃষ্টি কেটে যখন অাধো অালো অাধো ছায়া, তখনও পাশের কলোনির মেয়েটির মাথায় অামি ছাতা মেলে ধরে রেখেছি। তখনো মেয়েটির সাথে পদে পদ মিলিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ''হৈমি পরক্ষণে কোন পরিচয় বেছে নিয়েছিল?'' উত্তরে অামি বলি, 'হিমাদ্রী পরিচয়ে।' কেন? ভ্রু কুঁচকে মেয়েটি ফের জিজ্ঞাসা করে। অামি হাঁটতে-হাঁটতে বলতে থাকি, 'এই শহুরে সমাজ তাকে হৈমি হয়ে থাকতে দেয়নি। সুমনের নিরুদ্দেশের পর হৈমি চেয়েছিল, বাকি জীবন সুমনের হৈমি হয়ে থাকতে, খুব দূরে কোথাও সুমনের ভালোবাসার চাদর মুড়িয়ে নিঃসঙ্গভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু হিমাদ্রী নাম দেয়া শকুনরা ফের তাকে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যায় সেই পূর্ব নিষিদ্ধ জীবনে। এরাই হিমাদ্রীর অাত্মীয়। সেই ছোট্টকাল থেকে এরাই তাকে গড়ে তুলেছে। সময়ের বিরতিতে অাবার এরাই তাকে ভাগে নিয়েছে।' অাবার সে হিমাদ্রী হয়ে শহুরে পথ ধরে হেঁটে যায়, অচেনা জায়গায়, অচেনা মানুষের ঠিকানায়।
-
গল্পটি শুনে মেয়েটি ধীর দৃষ্টিতে অামার দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটির মাথা থেকে অালগোছে ছাতা নামিয়ে অামিও তার সাথে দৃষ্টি বদল করি। অামার কেন যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল তার এই দৃষ্টি। অজানা কারণেই ধকধক করে উঠে অামার ভিতর। যা চোখ খুলে এবং চোখ বন্ধ করেও অনুভব করতে পারি। মেয়েটির কলোনি তখনো পৌঁছায়নি। অামি থমথমে গলায় তাকে জিজ্ঞেস করি, ''অাচ্ছা, অাপনার নামটা জানতে পারি?'' উত্তরে মেয়েটি বলে উঠে, অাত্মীয় সমাজে অামার নাম, 'বৃষ্টি।' অামি বুঝতে পেরেছিলাম, মেয়েটির উত্তরে অামার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে উঠে। ততক্ষণে তার কলোনিতে পা পড়ে অামার। চারধারের সবকিছু খুব চেনা মনে হচ্ছিল। ঠিক যেন অামার গল্পের শহরের মতো সেই নিষিদ্ধপল্লি। অজান্তেই অামি তাকে প্রশ্ন করে বসি, ''হিমাদ্রীর মতো সেইসব অাত্মীয়?'' উত্তরে সে অামার চোখে দৃষ্টি রেখে মুহূর্তেই অশ্রু ছেড়ে দেয়। অার কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলে উঠে, ''অামি বৃষ্টি হয়ে বাঁচতে চাই না, দ্বিতীয় কোনো হৈমি হয়ে বাঁচতে চাই।''
বিশ্বাস করুন পিয়ার ভাই, তার কথায় অামি দ্বিতীয় কোনো সুমন হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অামার সমাজ তা মেনে নিবে না। মানুষ্য জীবনে সমাজ একটা বড় অাদালত। এই অাদালতে শ্রেণিভেদ অাইন রয়েছে। অামি সেদিন সেই অাইন ভঙ্গ করতে পারিনি। ফিরে চলে অাসি তাকে সেই জায়গায় রেখে। বাড়িতে পা দিতেই মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়েছিস তো ঠিক মতো? তখন অামি ফের দৌড়ে গিয়ে তাকে দেখতে যাই, কিন্তু পাইনি। শুধু সেই দিন নয়, তারপর শত খুঁজেও তাকে অার দেখতে পাইনি। ফিরে পাইনি অার কোনোদিন তাকে অামার দ্বিতীয় সুমন হওয়ার গল্প বলতে।''
-
হিমেল যখন এই পর্যন্ত বলে নিথর চাহনিতে জানালা দিয়ে তাকালো, তখন বাহিরে কালো রাতের অাঁধার। অামি জানি, তার দৃষ্টিতে তখন অাঁধার নয়, ভেসে বেড়াচ্ছে বৃষ্টি নামের মেয়েটির শেষ অাকুতির দৃশ্য।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন