মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮

পাঠ প্রতিক্রিয়া(বুক রিভিউ)

কাউসার মাহমুদ



বইঃ মর্নিংস ইন জেনিন ( সুপ্রভাত ফিলিস্তিন)
লেখকঃ সুজান আবুল হাওয়া
অনুবাদকঃ নাজমুস সাকিব
ঘড়িতে এখন ঠিক একটা বেজে উনত্রিশ মিনিট। বলা চলে রাতের মধ্যভাগ কাটিয়ে ফেলেছি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পৃথিবীর রাতের শহরগুলো। নীরবতার নিস্তব্ধ সম্ভোগ চারপাশ জুড়ে। আমার রুমমেট সকলের কপালে ঘুমদেব স্বপ্ন সাজাচ্ছে। আপাতত একটা নেশার মধ্যে আছি। পড়ার নেশা। ফিলিস্তিনের রক্তচোষা ইতিহাস।আমার সামনে #সুজান আবুল হাওয়ার "মর্নিংস ইন জেনিন"। কিছুক্ষণ হলো শেষ করেছি। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে পাঁচমিনিট নিঃশব্দে কেঁদে মিনিট দুয়েক জলের ঝাপটা দিয়েছি চোখে-মুখে। সুজানের এ বইয়ের অনুবাদ করেছেন তুখোড় মেধাবী নাজমুস সাকিব। নবপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ৩৫২ পৃষ্টার এ বইয়ের প্রতিটা পাতায় রয়েছে ফিলিস্তিনের হাড়গুড়ো করা রক্তাক্ত ইতিহাস।
(সুজান আবুল হাওয়া ও তার বই মর্নিংস ইন জেনিন,এবং অনুবাদক নাজমুস সাকিব আর তার "সুপ্রভাত ফিলিস্তিনের" কথা সামনে ছত্রে ছত্রে আসছে)

স্পষ্ট মনে নেই। তবে ধোঁয়াশা হয়ে চোখের পাতায় এখনও ভাসছে সেই রোদজ্বলা দুপুরের কথা। যেদিন এ্যালেক্স হ্যালির "শেকড়ের সন্ধানে" পড়ার পর হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। অমন দুপুরে হঠাৎ দরেজা বন্ধ করায় আমার আম্মা ভয় পেয়েছিলেন। পরে তাকে সবিস্তারে সে বইয়ের গল্প বলার পর তিনিও কেঁদেছিলেন। আফ্রিকার সে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শেতাঙ্গদের যে অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা। কুন্টা-কিন্টের সে মর্মান্তিক ইতিহাস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর যা তারা ইতিহাস করে রেখেছিল।
সে যাইহোক। তারপর বহুবছর কেটে গেলো। কোনও বই পড়ে আর অমন কাঁদা হয়নি। সামান্য উদ্বেগ,উৎকন্ঠা হয়েছিল ঠিক কিম্বা চোখের পাপড়ীতে জল টলমল করেছিল।কিন্তু অঝোরে কাঁদিনি আর একটিবার। হয়ত মন পাথর হয়ে গিয়েছিল অথবা বয়সের সাথে অনেকটা মানিয়েও নিয়েছি নিজেকে। শক্ত হয়েছি দিনদিন। কিন্তু এসব কিছু, আমার বয়সের সাথে সাথে আমার কঠোর মনোভাব।নিজেকে গুছিয়ে রাখা এবং ইমোশন না হওয়ার যে মনোবল ছিল। আবুল হাওয়ার "মর্নিংস ইন জেনিন"পড়ার পর। কাচের টুকরোর মতো নিমিষেই তা ভেঙ্গে গুড়োগুড়ো হয়ে গেল আজ। শেষ কান্না ছিল। বিগত তিনদিন ধরে বইটা একাকীত্বে পড়ছি আমি। কারো উপস্হিতিতে ওটা ছুঁয়েও দেখিনি প্রথমবারের পর। কারণ, কিছুদূর পড়ার পরই বুঝে গেয়েছিলাম। আমি অন্য কোথাও হাত দিয়েছি। যেখানে আমার মন ও চোখ আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমার কাঁদতে হবে। তাই গভীর রাতে পড়তে শুরু করলাম। আজ শেষ একশো একুশ পৃষ্ঠার মতো বাকী ছিল।এতক্ষণ আমার চোখ ভেজাই ছিল। পাঠ শেষে আনমনেই আরেকবার পাতাগুলো উল্টে দেখি মোট তিপান্ন জায়গায় ভেজা।
প্রচণ্ড দুঃখে ডুবে গিয়ে ডায়েরী ধরে বই সম্পর্কে লিখতে গেলাম। উপন্যাসের চরিত্রগুলো পুনঃপুন ভাসতে থাকে আমার মনের বারান্দায়। সেই জেনিন। ফিলিস্তিনের শহর। তার পাশেই এক গ্রামের গল্প দিয়ে কাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়া। তীন আর জয়তুন গাছে আচ্ছাদিত এক সুনিবিড় ছায়াবিথী গ্রাম। গ্রামের নাম আইনে হুজ। সেখানকার এক সাধারণ পরিবারের জীবনযাপনের গল্প। যেটা গত শতকের চল্লিশ দশকরে বর্ণনা। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে এভাবে, সে গল্প শুধু আইনে হুজেরই ছিলোনা। বরং পুরো ফিলিস্তিনের নারকীয় জীবনের গল্পের পাঠপিঠ। আইনে হুজ থেকে যার সূচনা হয়েছিল অত্যাচারের বিষাক্ত লেপ মুড়ে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিন্দু রক্ত কেড়ে নিতে নিতে ইয়াহুদিরা যে বিভৎস বিজয়োৎসব করেছিল তার কলজেপোড়া বিবরণীধারা।
দুরন্ত চটপটে চঞ্চল লাস্যময়ী বেদুইন কিশোরী ডালিয়া। উত্তপ্ত পাথুরে ভূমিতে ঝড় তুলে ছু্টতো যেন সময়ে। তার কোন বাঁধা নেই। বিরামের বালাই নেই তার। রোদে পুড়ে উসকোখুসকো তামাটে চুলের বিনুনি ছেড়ে দিত হুজের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কৃষক ইসমাইলের জয়তুন বাগানে। লুকিয়ে তীন গাছের পেছনে পাথরের উপর ছেড়ে দিত নিজের সমস্ত শরীরকে। ইসমাইলের ছোট ছেলে দারবিশের উড়ন্ত ঘোড়া ফাত্তুমের প্রেমে পড়ে যায় সে সময়। তার বালিকা সুলভ চপলতা ফাত্তুমকে চুড়ি করতে উদ্যত করে। কিন্তু ভাগ্যদেবী অপ্রসন্ন ছিলেন। পা থেকে নুপুর খুলে যাওয়া আর তার ঝুমঝুম শব্দে ধরা পড়ে যায় ডালিয়া। তারপর অদৃষ্টের লিখনে বাগদান হয় সে পরিবারেই। ইসমাইলের বড় ছেলে হাসানের সঙ্গে বিয়ে হয় ডালিয়ার। শাশুড়ি বাসিমা প্রথমে অখুশী হলেও ডালিয়ার ধৈর্য আর দেবীর সরলতা তাকে বাসিমার মেয়ে বানিয়ে দিয়েছিল।
পৃথিবীর সবুজ আর নিরুপমা মাখা সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল ফিলিস্তিন। শতবর্ষী পুরনো এ উপত্যকার সবটাই ছড়িয়েছিল সুখের সাতরঙা রেণু। ইসমাইল আবুল হিজার পরিবারের মত অসংখ্য পরিবার। কিন্তু ঠিক ১৯৪৮ সাল পৃথিবীর মানচিত্র ভেঙ্গে ফিলিস্তিনকে খামচে ধরে তাদেরই আশ্রিত জারজ ইয়াহুদিরা। মনুষ্য সর্বস্ব সাধারণত অনুভুতিটিও বিলীন হয়ে গিয়েছিল তাদের। একেকটা ইহুদি হয়ে উঠেছিল একেকজন ম্যানিয়াক। রক্তে যাদের পূর্ণ আনন্দ।
সেদিনের পর থেকে ফিলিস্তিন কখনও আর তাদের হারানো দিন ফিরে পায়নি। কোনওদিন জেনিনে আর একটা নিশ্চিন্ত নির্জলা সূর্যের উদয় হয়নি। এভাবেই কেটে গেছে ৭০ বছর। চারটা প্রজন্ম ধারাবাহিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে শেষঅবধি বীভৎস মৃত্যুতে নিজেদের নাম লিখে যায় ফিলিস্তিনের পথে। অথচ তাদের প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখত একদিন তারা নিজেদের সে পুরনো ঘরে ফিরে যাবে। যেখানে তাদের পূর্বপুরুষের বসবাস। যে মাটি একান্তই তাদের নিজস্ব।
বাসিমা তার পূত্রবধূ ডালিয়া তার মেয়ে আমাল এবং তার মেয়ে সারা।অপরদিকে ইউসুফ,হাসান,দারবিশ, ডেভিভ, আরি পার্লেস্টাইন, মাজিদ মোট চার প্রজন্মে ভাগ করা এ মানুষগুলোর জীবনের বহুমাত্রিক প্রবাহ তাদের পরাহত করে রেখেছিল নিদারুণভাবে। তাদের নিত্যকার দৃশ্য ছিল দানব ইসরাইলের-ট্যাংক, বুলডোজার,যুদ্ধবিমান, রাইফেল,রক্ত,ছিন্নভিন্ন দেহ।
তার তাদের জীবনকে সপে দিয়েছিল ভাগ্যের হতে।এতকিছুর পরও কখনও এদের মাঝে জিগরীদ বেজেছিল।তারা খুউব সামান্য হয়ে জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছিল বেচে থাকার আশায়। অথচ জীবনের কোনও এক সন্ধিক্ষণে সেটাও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফাতেমার পেটে থাকা সন্তানকে তার পেট ফেঁড়ে বের করেছিল!!! এভাবে প্রত্যেকটা মায়ের সাথে একই আচরণ হয়। শিশুদের মস্তক থেতলে দিতে তাদের বড্ড আনন্দ। আরো কত রকমের যে নৃশংসতা তা নাইবা লিখলাম। পাঠ করে একটু অশ্রুসজল হোননা।
এসব করুণ ও হৃদয়বিদীর্ণ বর্ণনা ধরেই এগিয়ে যায় গল্পের মূলপাঠ। এতোগুলো বছরের এ ধারাবাহিক বর্ণনায় কোথাও সামান্য ব্যবচ্ছেদ ঘটেনি। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকবেই।চোখের নীচ থেকে সমান একটা জলের ধারা গাল বেয়ে নীচ নেমে কখন যে শুকাবে, তা বোধ করি একবার পাঠেই অনুভব করুন।
ইতিহাসের যে নির্লজ্জ একটা অধ্যায় আছে ফিলিস্তিন অনুচ্ছেদে। সমগ্র আরববিশ্ব ও তৎকালীন পৃথিবীর রাজনৈতিক ভূমিকা কী ছিল! এবং ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা কোথা থেকে কাদের দোসর হয়ে ফিলিস্তিনের মাটি খামচে ধরলো। এসবের এক ঐতিহাসিক পার্চা আছে এ বইয়ে। সে সময়কার মানবাধিকার কর্মীদের যে রিপোর্ট ফিলিস্তিনিদের নিয়ে সেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কতোটা প্রভাব ছিল বা আন্তর্জাতিক বিশ্বই কতোটা প্রভাবিত হয়েছিল। সে সমস্ত দলিল দস্তাবেজ মাঝে-মাঝেই পাবেন পাঠক।
ফিলিস্তিনে কুফেইয়া পড়া প্রত্যেকটা শিশু স্বাধীনতার গন্ধে মাতাল। তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে রাইফেলের সামনে পাথর তুলে ধরে। মায়েরা তাদের সন্তান উৎসর্গ করে তাদের মাটির জন্য। কালো কুফেইয়া-ই যেন তাদের বিজয়ী প্রতিক।এভাবেই গল্পের বুননে সত্যকে সুস্পষ্ট করে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন আবুল হাওয়া।
নাজমুস সাকিব যে বাঙলা ভাষায় রুপান্তর করে আমাদের ইতিহাসের ঋণ মুক্ত করেছেন, এখানে নাজমুস সাকিবকে একশো থেকে একশো মার্কসের ক্রেডিট দেয়া উচিৎ। একদম কাটা অনুবাদ করে তিনি উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন সামান্তরিকভাবেই। সাবলীল ভাষায় বাঙময় বহিঃপ্রকাশ। যেটা একজন সাধারণ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পাঠককে মোহিত করে। নাজমুস সাকিব ভাষার সে ব্যবহারে ছিলেন একদম চৌকস। কোথাও কোনও অপ্রতুল ব্যবহারে তিনি অনুবাদকে মেদযুক্ত করেননি। সুজানের মতোই পূর্ণ কষ্টটা আমাদের হৃদয়ে পিষে দিয়েছেন।এ ক্ষেত্রে কোনই কার্পণ্য করেনি সাকিব।
শেষকথাঃ লেখক উপন্যাসের চরিত্র নির্ণয়নে বলেছেন, এসব কাল্পনিক। সত্য ও একটি নির্যাতনের ইতিহাসকে অমন সমৃদ্ধ করে রচনা, অনেকাংশে বাস্তবিক ছাড়া সম্ভব নয়। হয়ত নিজের ভেতরকার কোনও কষ্ট কিম্বা ব্যথাতুর কোনও বিয়োগ থেকেই লেখক শুধুমাত্র অন্য আরেকটি চরিত্রকে আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন।
১৭.৩.১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...