বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

বউয়ের লেখা ৫ পৃষ্ঠার বাজার লিস্ট!

আরিফুল ইসলাম

কারওয়ান বাজার, চারদিকে মানুষের কোলাহল। এরকম গিঞ্জি পরিবেশ ইহানের জন্য সবসময় বিরক্তিকর। ছোটবেলায় বাবার সাথে সব জায়গায় যেতে তার ভালো লাগলেও বাজারে যেতে ভালো লাগতো না। বাজারে মানুষ অযথা কথা বলে, তারউপর চারদিক থেকে মাছের গন্ধ, মোরগের গন্ধ, পঁচা শাকসবজির গন্ধে মনে হয় দম বন্ধ হবার উপক্রম!

সকালে অফিসে যাবার সময় বাবা ডাকলেন, একটু মুচকি হেসে বললেন, "এতদিন তো আমার স্ত্রীকে বাজার করে আমি খাইয়েছি। এখন তোমারও স্ত্রী আছে। আজ থেকে তুমিও বাজার করবা।"
বাবার কথা শুনার পর ইহানের মনে হলো, তার মাথায় ১০ কেজি ওজনের লোহার রড দিয়ে কেউ আঘাত করলো! কোলাহলপূর্ণ কাঁচাবাজার, চারদিকে ভোঁ ভোঁ দূর্গন্ধ, সেখানে গিয়ে সে বাজার করবে ?
অনুনয়ের সুরে বাবাকে বললো, "আচ্ছা বাবা, এরচেয়ে কঠিন কাজ দিন অসুবিধে নাই, তবুও এটা করতে বলবেন না, প্লিজ..। আর আমি বাজার করতে গেলে তো দরদাম করতে পারবো না, (হেসে বললো) শুধুশুধু টাকা লস হোক, সেটা তো আপনিও চান না।"
নিজের অবস্থানে অনড় থেকে বাবা বললেন, "দরদাম করতে করতে আস্তে আস্তে শিখে যাবা। প্রথমে লস হোক, আমার কোনো আফসোস নাই।"
বাবা ছেলের এই মিষ্টি তর্কযুদ্ধের মাঝখানে এসে উপস্থিত হোন, দুজনের স্ত্রী। ডাইনিং টেবিলে চায়ের কাপ দেওয়া হয়েছিলো অনেক আগে, তর্কযুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় চা খাবার কথা কারো মাথায় নাই।
চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে ইহানের চায়ের কাপ ইহানের হাতে দিলো লাফিজা, ইহানের বাবার চায়ের কাপ ইহানের মা নিয়ে আসলেন। মা ছেলের পক্ষ নেবেন না স্বামীর পক্ষ, আর লাফিজা ইহানের পক্ষ নেবে না শ্বশুরের পক্ষ, সেটা ভেবে প্রথমে দুজনই কনফিউজড।
একপর্যায়ে ইহানের মা ইহানের বাবাকে বলে উঠেন, "তুমিতো এতদিন বাজার করছো, এখন আবার হঠাৎ কী এমন হলো? আর আমার ছেলে তো বাজার করতে জানেনা, তুমি জানোই!"
এবার লাফিজা কার পক্ষে যাবে সেই কনফিউশন ভেঙ্গে মায়ের কথায় হালকা প্রতিবাদ করে বললো, "আপনি তো আদর করে করে ছেলেকে মাথায় তুলেছেন, এজন্য এতবড় ছেলে এখনো বাজার করতে জানেনা! আর বাবারও কি বয়স কম হয়েছে? আর কতদিন উনি বাজার করবেন?"
বউমার কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হলেন ইহানের বাবা।
অনেকক্ষণ ধরে চললো দুই পক্ষের এই মিষ্টি তর্ক। শেষমেশ দুইপক্ষ মিলে সিদ্ধান্তে আসলেন, মাসের অর্ধেক সময় বাজার করবে ইহান, আর বাকি অর্ধেক সময় ইহানের বাবা।
ছেলের উপর বাজার আনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে যতটা না ইহানের বাবা স্বস্তিবোধ করছেন, তারচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন, ছেলে কতটুকু সন্তষ্টচিত্তে সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করেছে।
অফিসে যাবার আগে ইহানের বাবা ইহানকে ডেকে নিয়ে বাজার করার কিছু টিপস দেবার পর ইহানকে দেখে মনে হলো, নাহ, ছেলেটা সন্তষ্ট মনেই বাবার দেওয়া দায়িত্বটা কাধে নিয়েছে।
কারওয়ান বাজারে ঢুকার আগে আশপাশের পরিবেশটা ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে ইহান। হাতে লাফিজার দেওয়া বাজারের লিস্ট। বাজারের লিস্ট এতবড় হতে পারে সে দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করেনি। পুরো ৫ পৃষ্ঠার একটা বাজারের লিস্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলির সামনে। লিস্টটা পড়া শুরু করতেই ভয় করছে, প্রথমদিন বাজার করতে এসে যদি এতবড় লিস্ট হাতে দেওয়া হয় তাহলে কিভাবে বাজার করবে। এটা ভেবে খানিকটা লাফিজার উপরও রাগ হলো!
বিয়ের আগে কে যেনো বলেছিলো, বিয়ে করো তারপর দেখবে স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়া মেটাতে জীবনটা যাবে। মাসে ৫০,০০০ টাকা রুজি করলে, স্ত্রীর চাহিদা হবে ১,০০,০০০ টাকা।
বিয়ের পর প্রথমবারের মতো বাজার করতে এসে ঐ উক্তিটা আবার মনে পড়লো ইহানের। তারমানে কি ঐ লোকের কথাটাই  সত্যি?
বাজারের লিস্ট পড়া শুরু করলো ইহান।
শুরুর কয়েকটা লাইন পড়েই চমকে উঠলো। একটা বাজারের লিস্টে লাফিজা এসব কি লিখেছে? ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার মাঝখানে। লাফিজার সুন্দর হাতের লেখাগুলো মুক্তোর মতো মনে হচ্ছে।
বাজারের লিস্টে কেউ এরকম কিছু লিখতে পারে, সেটা ইহানের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা বুঝতেই পারেনি।
প্রথম লাইনটা ছিলো এরকম,
"তোমরা যা কিছু ব্যয় কর (আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য), তিঁনি তার বিনিময় দেন। তিঁনি উত্তম রিযিক দাতা।"
"And whatsoever you spend of anything (in Allah's cause) Allah will replace it, and Allah is the best of Providers." [১]
পরের পৃষ্ঠা উল্টানোর পর দেখলো সেখানেও কোনো বাজার খরচের কথা লেখা নাই। যা লেখা আছে,
"আর আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য তুমি যে কোন ব্যয় করো না কেন, তোমাকে তার বিনিময়ে প্রদান করা হবেন এমনকি যা তুমি তোমার স্ত্রীদের মুখে তুলে দিবে (তারও প্রতিদান পাবে)।"
"You will get a reward for whatever you spend for Allah's sake, even what you put in your wife's mouth." [২]
এর পরের পৃষ্ঠায় লেখা,
"কোনো মুসলিম যদি আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য তার পরিবারের পেছনে টাকা ব্যয় করে, সেটাও তার জন্য সাদকাহ হবে।"
"If a Muslim spend on his family seeking reward from Allah, then it is charity for him." [৩]
এরপরের পৃষ্ঠায় ভাবছিলো খরচের নাম লেখা থাকবে, সেখানেও খরচের নাম লেখা না। সেখানে যা লিখা আছে,
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
"আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য এক দিনার ব্যয় করা, একজন দাসমুক্ত করতে এক দিনার ব্যয় করা, গরীব লোককে এক দিনার সদকা করা এবং পরিবারের পেছনে এক দিনার ব্যয় করা- এইসব মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো পরিবারের পেছনে এক দিনার ব্যয় করা।" [৪]
বাজারের লিস্টের শেষ পৃষ্ঠায় বাজার করার জন্য ৫ পদ খরচের নাম। আধঘন্টার মধ্যে বাজার খরচ করে গাড়িতে উঠলো ইহান।
মনে মনে চিন্তা করলো জীবনে তো অনেক বাজার করেছি নিজের জন্য, আজকের মতো তৃপ্তি তো এর আগে কখনো পাইনি।
গাড়িতে উঠার সাথে সাথে হালকা বৃষ্টি পরা শুরু হলো।
তোয়ালে দিয়ে মাথার পানি মুছে দিচ্ছেন ইহানের মা। মা'কে জিজ্ঞেস করলো, "বাবাকে দেওয়া বাজারের লিস্টের কোনো কপি কি তোমার কাছে আছে?"
বাবার ড্রয়ার থেকে সবগুলো বাজারের লিস্ট এনে ইহানের সামনে রাখলেন মা। আজ লাফিজা যা লিখেছিলো, সবগুলো বাজার লিস্টের শুরুতে  প্রায় একই কুরআনের আয়াত, একই হাদীস, ইহানের মা এতদিন তার বাবাকে লিখে পাঠিয়েছে।
দীর্ঘদিন মনে মনে পুষে রাখা এক প্রশ্নের উত্তর আজ ইহান জানতে পারলো।
মাঝেমাঝে পাশের বাসায় বাজার করা না করা নিয়ে ঝগড়া হয়। ঝগড়াগুলো শুনতে শুনতে ইহানরা অভ্যস্ত। তাছাড়া সব পরিবারেই এরকম বাজার করা নিয়ে ঝগড়া হয় হরহামেশা।
কিন্ত আজ পর্যন্ত বাজার করা নিয়ে ইহানদের পরিবারে কোনো ঝগড়া হয়নি তার মা-বাবার মধ্যে। তার কারণটা অজানা রয়ে যেতো, যদিনা আজ সে বাজারে গিয়ে তার স্ত্রীর দেওয়া লিস্টের প্রারম্ভিকতা না দেখতো, যদিনা তার মায়ের লিখা লিস্টগুলো না দেখতো।
সকালে যেখানে মনে মনে বাবার সাথে মিষ্টি তর্ক করেছিলো বাজারে না যাওয়ার জন্য, দিনশেষে মনে হচ্ছে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য বাজার করে আনার মতো সুবর্ণ সুযোগ কি আমি সকালে হারাতে যাচ্ছিলাম?
রেফারেন্স :
১। সূরা আস সা'বা, আয়াত ৩৯।
২। সহীহ বুখারী, হাদীস নাম্বার ১২৯৫। সহীহ মুসলিম, হাদীস নাম্বার ১৬২৮।
৩। সহীহ বুখারী, হাদীস নাম্বার ৪০১৬,৫৫,৫৩৫১। সহীহ মুসলিম, হাদীস নাম্বার ১০০২।
৪। সহীহ মুসলিম, হাদীস নাম্বার ৯৯৫। বই নাম্বার ১২, হাদীস নাম্বার ৪৮।
প্রেমের পাণ্ডুলিপি ০৫

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...