মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮

অন্তরালে

 শবনম চৌধুরী


---- মামণি, প্রেম করা পাপ ?
তিতলির এমন প্রশ্নে কিছুটা হকচকিয়ে উঠি । তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারছিলামনা কি উত্তর দেয়া যায় ! মেয়ের সাথে যতদূর পারি খোলাখুলি কথা বলার চেষ্টা করি । ওর সাথে আমার সম্পর্কটা যতটা না মা-মেয়ে তার চেয়ে বেশী বন্ধুর মতো । আজকালকার বারো বছরের কিশোরী অনেককিছু খুব সহজেই বুঝতে পারে । ওদের সাইকোলজি বুঝতে না পারলে একটা দূরত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । তাই, মেয়ের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর খুব সাবলীলভাবে দেয়ার চেষ্টা করি । সম্পর্কের ধারা যেমনই হোকনা কেনো তা রক্ষার ব্যাপারে আমার মাঝে সবসময় একটা দৃঢ়তা কাজ করে।

    মনে পড়ে, তিতলির বয়সে আমি কত বোকা আর অজ্ঞ ছিলাম । দোষটা আমার না ; সময় এবং যুগের কারণে আজকের একই বয়সী বাচ্চাদের মানসিকতা আর ঐ সময়ে আমাদের মানসিকতার এতো ব্যবধান । মেয়ের কাছে প্রেমের সুন্দর শোভন দিকগুলো
কিছু উপমাসহ তুলে ধরে যতদূর সম্ভব ওর প্রশ্নের স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করলাম । কৌতূহলী বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার ; প্রেম সংক্রান্ত ওর ভেতরে যত প্রশ্ন জেগেছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুলোর উত্তর জেনে নিলো । আমিও এর ভাল দিক মন্দ দিকসহ খুঁটিনাটি সবকিছুই ওকে বুঝিয়ে বলেছি ।
টিভিতে একটা মুভি দেখতে দেখতে ওর মনে এতো প্রশ্ন জেগেছিলো ! সে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো মুভির মাঝে ।

    বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম । বৃষ্টিতে সদ্যস্নাত প্রকৃতি, ভেজা হাওয়া, ভেজা মাটির গন্ধ বেশ ভালো লাগছে । বারান্দার গ্রিলে ঝুলন্ত টবে বিভিন্ন ধরণের পাতাবাহার । প্রতিটির আকৃতি অনেকটা হৃদয়ের মতো । বৃষ্টিধোয়া প্রতিটি সবুজ হৃদয় আরো সতেজ, সুন্দর, অপরূপ হয়ে উঠেছে ! হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন যেনো করে উঠল ! একটা সূক্ষ্ম হাহাকার !

    হারিয়ে গেলাম তিতলির বয়সে । তখন সবেমাত্র ক্লাস এইটে উঠেছি । খুব দুরন্ত ছিলাম । মেয়েলী কোনো স্বভাব ছিলোনা । যখন তখন স্কুলের মাঠে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে লেগে যেতাম । ছুটতাম প্রজাপতি আর ফড়িং এর পিছু পিছু । হাডুডু, কানামাছি, গোল্লাছুট, ঘুড়ি উড়ানো কিছুই বাদ নেই । ক্লাসের সবাই তখন চঞ্চলা হরিণী । শুধু একজন ছিলো প্রচন্ড ধীর, স্থির, শান্ত ! আমাদের চেয়ে বয়সেও বেশ খানিকটা বড় ছিলো সে । বয়সের তুলোনায় অনেক বেশী ভারীক্কিভাব ছিলো ওর চলনে বলনে যা কি না ঐ বয়সে বেশ বেমানান ! ঐটুকু বয়সে ঠিকরে পড়া রূপ আর বড় বেশী মায়াবতী মেয়েটির নাম লাবণ্য । আমরা যখন শালিক ধরে পাখায় সূতো বেঁধে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠতাম, তখন লাবণ্য এসে খুব যত্ন করে সূতো খুলে পাখীটিকে আকাশে উড়িয়ে দিতো । আমরা সবাই ঘুড়ি আর বল নিয়ে মাঠে ছুটোছুটি করে যখন ধুলোর মেঘ উড়াচ্ছি, লাবণ্য তখন চুপটি করে মাঠের এককোণে গাছের ছায়ায় বসে নোটখাতার ভেতর লুকিয়ে রাখা নীল মলাটের গোপন আরেকটি খাতায় কী যেনো লিখে ! মাঝে মাঝে খুব সন্তর্পণে চারপাশে তাকিয়ে জামার ভেতর থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করে খাতার ভাঁজে রেখে সাবধানে পড়ে আবার জামার ভেতর অথবা ওড়নার ভাঁজে লুকিয়ে রাখে !
সবাই লাবণ্যকে অহংকারী ভেবে এড়িয়ে চলতো ।

    ঐবার স্কুল থেকে পিকনিকে কাপ্তাই গেলাম । একরাত দুইদিনের ট্রিপ । বাসে চড়ে সকালে রওয়ানা হয়ে ওখানে পৌঁছলাম দুপুর বারোটার দিকে । নেমেই আমার চোখ পড়ল কয়েকগজ দূরে ২০/২১ বছরের একজন উঠতি তরুণ লাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ছে ! ছেলেটিকে আগেও বেশ কয়েকবার স্কুলের আশেপাশে দেখেছি । লাবণ্যও মিষ্টি হেসে হাত নেড়েছিল । ব্যাপারটি আমাদের স্পোর্টস টিচারের দৃষ্টি এড়ায়নি ! উনি সোজা ছেলেটির কাছে গিয়ে খুব করে বকে দিলেন ; আর সাবধান করলেন পিকনিক স্পটের ত্রিসীমানায় দেখলে পুলিশে ধরিয়ে দিবেন । স্যার লাবণ্যকেও খুব বকাঝকা করলেন ---
----- ইঁচড়ে পাকা মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বের হবে আর এই বয়সেই নোংরামি !! 


    আমরা সবাই খুব মজা করে সমস্ত এলাকা ঘুরে দেখতে লাগলাম । প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ রস রঙ ঢেলে উদার হস্তে সাজিয়েছে সম্পূর্ণ কাপ্তাই এলাকা ! সবাই একসাথে চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছিলাম "কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে" । আহা ! কি অপরূপ ! কি সুন্দর আতাফল বাগান, লেবু বাগান ! ইচ্ছেমত সবাই আতাফল নিলাম , কেউ বাধা দেয়নি । দেখলাম কাপ্তাই লেক, বাঁধ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র । একজন গাইড সমস্ত প্রকল্পটি  সুন্দর সহজভাষায় স্পষ্ট বর্ণনায় বুঝিয়ে দিলেন । 

    "ছুটির ঘন্টা" ছায়াছবির কাহিনীটি যে স্কুল কেন্দ্রিক সেই স্কুলে আমাদের বিশ্রাম এবং থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল । সন্ধ্যার পর ঐ স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষক সেই মেধাবী ছাত্রটির করুণ মৃত্যুর ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করলেন । উনার নিখুঁত বর্ণনায় আমাদের গায়ের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেলো । প্রায় আমাদের বয়সী ছাত্রটির অপমৃত্যুর ঘটনা শুনে কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । শুধু লাবণ্য এককোণে বসে আনমনে অন্যকোনো ভাবনায় ডুবে ছিলো ।


    বছর গড়িয়ে বার্ষিক পরীক্ষা, বৃত্তি পরীক্ষা সবই শেষ । কিন্তু লাবণ্য পরীক্ষা দেয়নি ! 
    শেষ পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো দলবেঁধে সবাই লাবণ্যের খোঁজ নিতে গেলাম ওর বাসায় । ওর মা দরজা খুলেননি ! ব্যালকনি দিয়ে মাথা বের করে খুব বাজেভাবে খিস্তিখেউড়ে আমাদেরকে কুকুর বেড়ালের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন । উনার সে কি ভয়ঙ্কর মূর্তি !! আর দাঁড়ানোর সাহস পাইনি । হঠাৎ চোখ গেলো লাবণ্যর ঘরের আধখোলা জানালায় -- অন্ধকার ঘরে ওর মলিন চাঁদমুখ আর চোখজুড়ে জল টলমল স্পষ্ট দেখতে পেলাম ! ভেতরটা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠল ! মনে হলো জেলখানায় বন্দিনী ভীত হরিণী লাবণ্য অনেককিছু বলতে চায় ! কিন্তু রুদ্রমূর্তি মায়ের ভয়ে কিছুই পারছেনা !
উচ্ছল সহজ সরল কৈশোরে এই প্রথমবার জটিল কিছুর আভাস পেলাম ! হয়তো ভয়ঙ্কর কিছু ! ইচ্ছে হলো সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে মুক্ত করে নিয়ে আসি লাবণ্যকে । পারিনি ! বয়স, সমাজ, সময়, পারিপার্শ্বিক আতঙ্ক কোনোকিছুই আমাকে এগুতে দেয়নি !

    আবার শুরু হওয়া বছরটির শুরুতেই নতুন ক্লাস নতুন বইয়ের আমেজের সাথে সাথে বার্ষিক স্পোর্টস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমেজেও সমস্ত স্কুলে একটা উৎসব উৎসব ভাব । এরমাঝে লাবণ্যকে খুব মনে পড়তে লাগলো । আবৃত্তি এবং কেরাত প্রতিযোগিতার প্রথম পুরষ্কারটি থাকতো ওর দখলে । এতো মিষ্টি করে আবৃত্তি আর কখনো শুনা হয়নি ! 

আমরা সবাই রিহার্সেল নিয়ে ব্যস্ত ...হঠাৎ দেখি বড়ক্লাসের আপু-ভাইয়ারা কি নিয়ে যেনো বেশ উৎকণ্ঠিত! অস্থির দৌড়াদৌড়ি ! ফিসফিস ! বারবার লাবণ্য নামটি কানে আসছে ! স্যার ম্যাডামদের সাথে আপুভাইয়ারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন লাবণ্যদের বাসার উদ্দেশ্যে ! ভয়ঙ্কর কিছু একটা আঁচ করতে পেরে আমরাও ছুটলাম পিছু পিছু !
লাবণ্যের বাসার কাছাকাছি পৌঁছাতেই ওর মায়ের বিলাপ সুরে কান্না শোনা যাচ্ছিলো -----
------ ও লাবুরে...ক্যান তোরে পেটে ধরছিলাম রে ...পোড়ামুখী ...ওরে পাপী...ক্যান ফাঁসি নিলিরে ...তোরে জনম দিয়ে কি পাপ করছিলামরে !! 

আরো কত উদ্ভট বাক্যে বিলাপ !! আমরা পৌঁছার পর পর একটা পুলিশভ্যান এসে থামল । পুলিশ অফিসার চারজন সহকারীসহ ভীড় ঠেলে ঢুকার সময় পিছু পিছু ঢুকে গেলাম আমরাও ।

শীতলপাটিতে শুয়ে আছে লাবণ্য ! নিথর ! শীতল দেহ ! গলায় প্যাঁচানো শাড়ীর আঁচল ; মুখটা আতঙ্কগ্রস্ত, নীল ! ঠিক যেনো ওর সেই গোপন খাতার নীল মলাট ! জিহ্বা বের হয়ে আছে ! এতোসুন্দর চোখদুটো ঠিকরে বের হওয়া বিস্ফারিত রক্তঝরা টুকটুকে দুটো বল ! মাগো ! কি ভয়ঙ্কর ! ভেতরটা গুলিয়ে উঠলো ! আর দাঁড়াতে পারিনি । ঘুরে দৌড়াতে থাকলাম...দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় পৌঁছেই আম্মুর বুকে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম ! আম্মু বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মমতামাখা হাত বুলিয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে -- কিছুই বলতে পারছি না ! কথা বলার শক্তি নেই ! কান্না করতে করতে কখন যে আম্মুর বুকের ওমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি ।
ঘুম ভাঙার পর কাউকে কিছু বলতে হয়নি ; ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে ।।


    লাবণ্যের ছোটভাই অপু ছিল আমার বয়সী । যদিও সে এক ক্লাস জুনিয়র ছিল তাতে কি ! ফুটবল, কানামাছি, হাডুডু একসাথেই খেলতাম । সেই পিচ্চিকাল থেকে অপু আর আমি খুব ভালো বন্ধু । লাবণ্যের মৃত্যুর পর অপু বদলে যায় ! ওর চোখে মায়ের প্রতি ছিল একরাশ ঘৃণা ! মায়ের প্রসঙ্গ এলেই ঘৃণায় ওর চোখমুখ কুঁচকে যেতো ! বেশ কিছুদিন বিকেলে মাঠে খেলতে আসেনি ! একদিন অনেক কষ্টে রাজী করিয়ে নিয়ে এলাম । মাঠে যাওয়ার পথে হঠাৎ রাস্তার একপাশে বসে হূহূ করে কেঁদে উঠল সে ! জানতে চাইলাম । চোখদুটো মুছে খপ করে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল -----
---- চল
---- কোথায় ?
---- সাগরপাড়ে । তোকে অনেককিছু বলার আছ

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে "না" বলতে পারিনি । রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম সৈকতে । অপু আর আমি বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ হাঁটলাম । মাঝে মাঝে আনমনে কুড়ালাম শামুক, ঝিনুক । কিছুদূর একটু উঁচু বালির ঢিবিতে ছড়িয়ে থাকা লতানো গাছের হৃদয় আকৃতির সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘন্টার মতো ফুটে আছে হালকা বেগুনী ফুল । অপু ওখানে ধপ করে বসে পড়তেই আমিও বসলাম পাশে । তখন অপু যা শোনালো সেটা শুনার জন্যে মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না ! মৌনতা ভেঙে প্রথমে প্রশ্ন করলো ----
---- হিমি, পিশাচ দেখেছিস ?
---- না রে । হরর কাহিনীতে শুধু পড়েছি আর মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখেছি ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপু বলল
---- আমার মাকেতো দেখেছিস ?
মাথা নাড়লাম ।
---- জ্যান্ত পিশাচী ! এই ডাইনী আমার লাবুবুকে গলা টিপে মেরে ফেলেছেরে হিমি !

ভেতরটা কেঁপে উঠলো ! কিছু বললাম না ; শুধু আমার ডানহাতটি শক্ত করে ধরে থাকা অপুর হাতের উপর বামহাত রাখলাম ।
---- পৃথুল স্যার (গৃহশিক্ষক) আর লাবুবু লুকিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করেছিলো । ওখান থেকে বাসায় না ফিরে সোজা চলে যায় স্যারের বাসায় । ঐদিন লাবুবু বাসায় না ফিরায় সবাই পাগলের মতো চারদিক খোঁজাখুঁজি করে । কোথাও না পেয়ে থানায় জিডি করে । পুলিশ তিনদিন পর কিভাবে যেনো খবর পেয়ে স্যারের বাসা থেকে বুবুকে নিয়ে আসে । লাবুবু আসতে চায়নি ! সবাই জোর করে ধরে নিয়ে এসেছিলো । স্যার তখন পুলিশ অফিসার আর আব্বুআম্মুর পা ধরে সে কি কান্না ! বারবার বলছিল সে লাবুকে ছাড়া বাঁচবেনা ! কে শুনে তার আহাজারি ! আম্মু হাইহিল স্যু পরা পা দিয়ে লাথি মেরে স্যারের মুখ থ্যাতলে দেন ! তবু স্যার পা ছাড়েননি । বুবুকে ধরে এনে সোজা ওর রুমে তালাবন্দী করে রাখা হয় । আব্বু স্যারের পরিবারের উপর অপহরণ মামলা ঠুকে সবাইকে জেলে পাঠালেন । ঘুষখোর পুলিশ অফিসার আব্বুর ছড়ানো টাকার গন্ধে প্রভুভক্ত কুকুর হয়ে উঠল । এদিকে লাবুবুর উপর চলল অস্বাভাবিক নির্যাতন । 
---- কেনো ? 
---- স্যারকে ডিভোর্স দিতে রাজী হয়নি, তাই । ওদের দুজনকেই শর্ত দেয়া হল ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর দিলেই স্যারের পরিবারের উপর থেকে মামলা তুলে মুক্তি দেয়া হবে । কিন্তু দুজনের কেউই আলাদা হতে রাজী হয়নি । তাই জেলখানায় চলল স্যারের উপর নির্যাতন আর এদিকে বুবুর উপর । যেদিন বুবু চলে গেলো তার আগের দিন থেকেই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । একফোঁটা পানিও দেয়া হয়নি ! 
---- তুই কেনো বাধা দিসনি কেনো ? কেনো খেতে দিসনি ?
---- চাবি থাকতো আম্মুর আঁচলে । নির্যাতন করার সময় রুমের ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেয়া হতো ! ঐদিন আম্মুর জেদের মাত্রা ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের ! স্বাক্ষর নিয়েই ছাড়বেন । বুবুটাও ছিলো খুব জেদী ! আম্মু সমানে “পাপিষ্ঠা, নষ্টা, তোর জন্যে সমাজে মুখ দেখাতে পারছিনা” বলে বলে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকলেন ! অত্যাচারের পর অত্যাচারেও লাবুবু অটল ! আম্মু ওর গলা চেপে ধরলেন ! বুবুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো , তবু হার মানেনি ! দরজার ফুটো দিয়ে কাপুরুষের মতো সবকিছুই দেখছিলাম ! ভয়ে নড়তে পারছিলাম না ! কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিলো কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না ! জানিস হিমি ? খুব অবাক হয়ে দেখলাম পিশাচী মা কিভাবে আলনা থেকে টান দিয়ে শাড়ী নিয়ে নিজের সন্তানের গলায় বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিলো ! আমি তখন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছি ! ধীরে ধীরে পিছু হটে বাথরুমে গিয়ে লুকালাম । ভয় হচ্ছিলো ডাইনীটা টের পেয়ে না আবার আমাকেও ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয় ! বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ ! কতক্ষণ বাথরুমে ছিলাম জানিনা ! আম্মুর চিৎকার করে কান্নার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলাম । চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে তখন সে সবাইকে জানান দিচ্ছিলো লাবুবু আত্মহত্যা করেছে !! সবাই সত্যি সত্যিই এটাকে আত্মহত্যা ভেবে নিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কতভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো !! আব্বু তখন বাসায় ছিলেন না । খবর পেয়ে ছুটে এলেন । পরে উনি কিছু বুঝেছিলেন কি না জানিনা তবে ঐ মুহূর্তে শুধু আমি আর পিশাচী জানি লাবুবু আত্মহত্যা করেনি !!"


    পৃথুল স্যারের শেষ পরিণতি জানা হয়নি, কারণ অপুর অসংলগ্ন আচরণে ওর মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন গুপ্তহত্যার ব্যাপারটি তার অজানা নেই । অপুর বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খুব দ্রুত ওকে দার্জিলিঙের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন ।

যাবার আগে অপু দেখা করতে এসেছিলো । বন্ধুকে বিদায় দিতে ভীষণ কষ্ট ! কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার ব্যাপারটিতে অপু বেশ খুশী । লাবণ্য মারা যাওয়ার পর সে নাকি একটি রাতও ঘুমাতে পারেনি ! চোখের পাতা মুদে আসলেই দেখতো লাবণ্য ওর সিথানের কাছে বসে কাঁদছে ! এছাড়া আতঙ্কে ছিল -- ওর মা হয়তো ওকেও গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেন কারণ উনার অপকর্মের একমাত্র সাক্ষী সে । আর কিছুদিন এই বাসায় থাকলে হয়তো উম্মাদ হয়ে যেতো ! এবার মুক্তি । পিশাচপুরী থেকে বের হয়ে সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে । 

বিদায়ের ক্ষণে চোখে চোখ রেখে বলল -----
---  ভালোবাসা পাপ রে হিমি ! যদি কোনোদিন এই পাপকে সহজভাবে নিতে পারি তবে শুধু তোর জন্য ফিরে আসবো । পারবি এক পিশাচীর সন্তানকে ভালোবেসে আগলে রাখতে ?

ওর হাতটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম । বুকের ভেতর শুরু হলো অজানা তোলপাড় ! হাড়পাঁজরসহ ভেতরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠে এসেছে ! গলার নীচটুকু একেবারে ফাঁকা ! ভীষণ কষ্ট ! ভীষণ অস্বস্তি ! কিছুই বলতে পারিনি ! বেশ বুঝতে পারছিলাম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমূল্য সম্পদটি চলে যাচ্ছে অপুর সাথে ! নিজেকে ভীষণ শূন্য মনে হলো ...।।


    নাহ ! আমার বিয়ের আগে অপু ফিরেনি । এখনো জানিনা সে ভালোবাসাকে সহজভাবে নিতে পেরেছে কী না !! সে কি এখনো .........?? কেমন আছে অপু ? খুব জানতে ইচ্ছে করে !


ঝুলবারান্দায় রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে কখন যে তন্দ্রাভাব এলো টের পাইনি !
টুংটাং শব্দে বেজে উঠল কলিংবেল । বোধহয় ছুটাবুয়া এসেছে ।
বৃষ্টিধোয়া সবুজ পাতাবাহার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম আর বহুবছর আগের সৈকতের সেই বেগুনী ঘন্টাফুলের হৃদয় আকৃতির সবুজ পাতাগুলো স্মৃতির অন্তরাল থেকে জীবন্ত হয়ে উঠলো ।

---- মামণি মামণি......

মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর দুহাত ভর্তি কয়েক প্যাকেট চকলেট ।

 ----  মামণি, একজন আঙ্কেল এসেছেন । নাম বললেন অপু ।।

------------------------------ সমাপ্ত ---------------------------

#গল্পগ্রন্থ --- আমার হিয়া পায়না বিরাম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...