ব্যাগ থেকে মামুন সাহেব একটা ডায়েরি বের করলেন। খুব যত্নসহকারে ডায়েরির পাতাগুলি উল্টাচ্ছিলেন। অনেক আগের ডায়েরি হওয়ায় পাতাগুলি কেমন যেনো একটা আরেকটার সাথে লেগে ছিলো। লেখার কালিও ছড়িয়ে পড়েছে।তারপরও মামুন সাহেব পড়ার চেষ্টা করছেন। এতোদিন ডায়েরিটা পড়ার সাহস তার ছিলো না। কিন্তু আজ পড়তে ইচ্ছা করছে তার। কী লিখা আছে ডায়েরিতে? লিখাগুলো কি তিনি পড়তে পারবেন? সহ্য করার শক্তি কি আল্লাহ তাকে দিবেন? না! মামুন সাহেব আর ভাবতে পারছেন না। চোখটা তাই বন্ধ করে বহুদিনের সেই চাপা দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জল ফেললেন তিনি।
ডায়েরির প্রথম পৃষ্টায় একটা তারিখ লেখা। তারপরই লেখা আজ খোকার জন্মদিন। আমাদের পৃথিবী আলো করে খোকা এসেছে। নিচে কাঁপা কাঁপা হাতে তার মায়ের স্বাক্ষর দেওয়া। এভাবে প্রতিটা পৃষ্ঠায় তার মা তার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো লিখে রেখেছিলেন। কবে তার খোকা হাঁটতে শিখেছে, কবে প্রথম কথা বলেছিলো, কবে মা বলে ডেকেছিলো সব ডায়েরিতে লিখা ছিলো। তার ছোটবেলার সব কাহিনী ডায়েরিটাতে লিখাছিলো। পড়তে পড়তে কখন যে বেলা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে, সেটা মামুন সাহেব বুঝতেই পারেননি।
এই ডায়েরিটাতে তার ছোটবেলার কাহিনী ছিলো। মাঝের ডায়েরিগুলো মামুন সাহেব পাননি। তবে তার মায়ের শেষ ডায়েরিটা তিনি পেয়েছেন তার বাড়ির স্টোররুম থেকে। ধুলোয় জমা ছিলো ডায়েরিটা। মামুন সাহেবের মায়ের কান্নাগুলোও জমা ছিলো ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায়। মামুন সাহেব যখন স্টোররুমে থাকতেন, তখনই ডায়োরি পেয়ে অঝরে কেঁদেছিলেন। কারণ, এই স্টোররুমে তিনি তার মাকে রেখেছিলেন। যদিও মামুন সাহেব তার মাকে একবছর রেখেছিলেন স্টোররুমে। কিন্তু তার ছেলে তাকে একমাসের কম সময় রেখেছিলো স্টোররুমে।
নিলয় মামুন সাহেবের ছেলে। একটি মেয়েও আছে তার। সুখের জীবনই পার করছিলেন তিনি।ছোটবেলায় বাবা-মার অাদরে বড় হয়েছেন। বিয়ের পরে নতুন সংসার। তারপর নিলয় আর নীলিমার আগমন। সব মিলেয় ভালই ছিলেন তিনি। শুধু মাঝে বিরক্তির কারণ ছিলো তার বাবা-মা। বৃদ্ধ বাবা-মাকে তিনি স্টোররুমে রেখেছিলেন একবছর। যদিও এর মাঝে তার বাবা মারা যান। মাকে তাই একবছর স্টোররুমে রেখেছিলেন। পরে সেখান থেকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। প্রথম প্রথম মাকে দেখতে যেতেন। কিন্তু ২/৩ মাস পর সেটাও যেতেন না। ভুলেই হয়তো গিয়েছিলেন, তার মা বলতে কেউ আছে। আজ সব পুরনো স্মৃতি মামুন সাহেবের মনে পড়ছে। আর চোখ দিয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টির মত জল পড়ছে। মামুন সাহেবের মা যখন মারা যান, তখন বৃদ্ধাশ্রম থেকে তাকে ফোন করে বলা হয়, তখনো তার চোখেমুখে বিরক্তিভাব ছিলো। কারণ, চারদিন পরেই নিলয়ের জন্মদিন। সে জন্য তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন। তার স্ত্রী না করেছিলো লাশ আনতে যাওয়ার জন্য। তবুও তিনি গিয়েছিলেন মায়ের লাশ আনতে। হয়তো ঐ বিরক্তির মাঝেও মায়ের জন্য একটু বুকটা হাহাকার করছিলো, তাই স্ত্রীর কথা না শুনেই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলেন মায়ের লাশ আনতে। তখনই বৃদ্ধাশ্রমের লোকেরা তাকে তার মায়ের শেষ ডায়েরিটা দিয়েছিলেন। শেষবারের মত মায়ের মুখটা দেখে তার চোখ থেকে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিলো। তবে সেটা লোক দেখানো কান্না নাকি সত্যিই মা হারানোর কান্,না সেটা কেউ বুঝতে পারে নি।
মামুন সাহেব তার স্ত্রীর হাতে মায়ের শেষ ডায়েরিটা দেন রাখার জন্য। কিন্তু হতভাগিনী মায়ের ডায়েরিটারও জায়গা হয়নি তাদের রুমে। তার মতই স্টোররুমে জায়গা হয়েছিলো ডায়েরিটার। সময়ের পরিবর্তনে মামুন সাহেবেরও জায়গা হয়েছিলো স্টোররুমে। যদিও তার স্ত্রী এই দৃশ্য দেখার আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন।
আজ মামুন সাহেবের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। এতোবছর এই দিনটা তার মনে থাকতো না। কিন্তু আজ ঠিকই মনে রয়েছে। খুব ভাল করেই মনে রয়েছে। তাই মায়ের স্মৃতিচারণ করছেন তিনি। তার মায়ের শেষ ডায়েরিটা স্টোররুমে পাওয়ার পরই পড়েছিলেন কয়েকবার । প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে-কী লেখা আছে ডায়েরিতে। তবুও আজ আবার পড়ছেন।
"খোকা আজ আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেলো। তা নিয়ে আমি একটুও কষ্ট পাইনি। যেদিন থেকে খোকা আমার সাথে আর ওর বাবার সাথে উচুঁ গলায় কথা বলতে শুরু করেছিলো, সেদিনই বুঝেছিলাম আমার ভাগ্যটা বদলাতে শুরু করেছে মনে হয়। তবে সেটা যে বৃদ্ধশ্রম পর্যন্ত গড়াবে, তা বুঝতে পারিনি। যেদিন খোকা বললো- ''তোমরা স্টোররুমে থাকবে"। সেদিন কথা বলার ভাষাটা হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের দুজনেরই। খোকার বাবা মরে গিয়ে ভালই করেছে, আমি যে কেনো এখনো মরছি না, বুঝতেই পারছি না। বৃদ্ধাশ্রমে আসতে কষ্ট হচ্ছিলো শুধু দাদুভাইদের জন্য। যদিও ওদের মা আমার কাছে খুব একটা আসতে দিতো না। তাও ওরা দুইভাইবোন লুকিয়ে লুকিয়ে আসতো আমার কাছে। "
কিছু পৃষ্ঠার পর....
"খোকার আজ আসার কথা ছিলো। আসলো না কেনো বুঝতে পারছি না। দুই-দুইবার ফোন করলাম অফিসের ফোন থেকে। একবার রিং হলো পরেরবার বন্ধ বললো। ঠিক বুঝতে পারছি না খোকার কোনো অসুখ হলো না তো আবার?...."
এই জায়গাটায় এসে মামুন সাহেব প্রতিবারের মত নীরবে কান্না শুরু করলেন। এই নীরব কান্নার ভিতর শত শত চিৎকারের আওয়াজ লুকিয়ে আছে। যা কিনা গলা দিয়ে বের হতে পারে না।
আরো কিছু পৃষ্ঠা পর........
"আজ প্রায় ২ মাস হয়ে গেলো খোকা একবারও আমাকে দেখতে আসেনি। ওর কি বড় কোন অসুখ হলো? খোকা কি ভাল আছে? কিছু হয়নি তো খোকার আবার? আচ্ছা খোকা কি আমাকে দেখতে আর আসবে না? খোকা! তোর কি একটুও সময় হয় না আমাকে দেখতে আসার? নাকি ভুলেই গেলি আমাকে বাবা? প্রতিদিন আমি আশায় থাকি এই বুঝি তুই এলি। কিন্তু সে আাশা আমাকে প্রতিদিনই নিরাশ করে। জানিস খোকা! এখন না প্রায়ই মনে হয় যে, আমি মরে গেলেও কি তুই আমাকে দেখতে আসবি না..."
ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখলেন মামুন সাহেব। আর পড়তে পারছেন না তিনি। দুভচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ভাবছেন, নিলয় যা করেছে তাতে তো ওর কোনো দোষ নেই। এতো আমার কাজেরই প্রতিচ্ছবি। সময়ও যে কথা বলে তাই এখন বুঝছি। আল্লাহ না করুন, হয় তো নিলয়ও একদিন বুঝবে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন