শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮

৩য় স্থান অধিকারীর গল্প

মোহাম্মদ জয় আলম


নেহার বিয়ে হলো এ নিয়ে সাতমাস। এর মাঝে তাকে চারবার মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়েছে। নাহ, কোন গর্ভজনিত কারণে নয়। স্বামীর অবাধ্য অসংযম ক্রোধের ফলশ্রুতিতে তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছে কয়েকবার। সে একবার গ্লিজার অন করতে ভুলে গেল, স্বামী আসাদ মেরে হাত ভেঙ্গে ফেলল তার। খাবারে একবার ঝাল বেশী হল, তো সে ধাক্কা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো নেহার। এরকম কথ্য-অকথ্য নির্যাতনে চলছে নেহার কল্পিত নান্দনিক দাম্পত্যজীবন। তুচ্ছ কারণে আসাদ যখন নেহাকে বিশ্রী ভাষায় গালাগাল আরম্ভ করে, খুব স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয় পাশকরা নামীদামী পোস্টে চাকুরীরত আসাদ মাত্র আঠারো বছরের পদ্মরাগ তরুণীকে মারধর করে; সে তখন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।  যখন সে ভাবে, কী সুন্দর মোহময় ভেবেছিল সাংসারিক জীবন, কেমন বিষাদময় হয়ে দেখা দিল তা-তখনই নেহা ডুকরে কেঁদে উঠে।
শেষবার যখন নেহা মাথার ব্যান্ডেজ খুলতে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলেন- সমস্যা কি আপনার? কী করে এত ঝামেলা বাঁধান, বলুন তো? হাত ভাঙ্গেন, মাথা ফাটান। আপনি তো আর কচি খুকি না।
নেহা এর উত্তরে কী বলবে খুঁজে পায়না। গোল্ডরিস্ট চশমা পরা সফেদ দাড়িওয়ালা এই ফেরেশতা সাদৃশ্য মানুষটাকে মিথ্যা বলা কি ঠিক হবে? সত্যটাই বা কী করে বলবে? নেহা চুপ করে রইল। তার অজান্তে একফোঁটা জল তার গাল বেয়ে মন্থর গতিতে নামছে।
ডাক্তার সাহেব বুদ্ধিমান লোক। তিনি প্রেস্ক্রিপশন দিতে দিতে বললেন- আপনার হাজবেন্ডের অফিসের ঠিকানাটা আমাকে দিন।  আমি উনার সাথে দেখা করব।
পরদিন ডাক্তার শামছুল আরেফিন নেহার স্বামীর সাথে ঠিকই দেখা করলেন। কী থেকে কী হয়ে গেল। দেখা গেল-এর পরদিন নেহার স্বামী একদল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর,অধ্যাপক এর সাথে চল্লিশ দিনের জন্য তাবলীগে যাচ্ছে।   নেহার স্বামী রওয়ানা হওয়ার সময় যখন নেহাকে বলেছিল- 'তোমাকে যথেষ্ট কষ্ট দেয়া হল নেহা, যাই, দোয়া রেখো'। নেহা তখনও চুপ ছিল। অধিক বেদনাকাতর হলে মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু অধিক সুখপ্রাপ্ত হলে মানুষ আনন্দে খানিকক্ষণ পাথর হয়ে যায়। নেহা তখন সুখে-আনন্দে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
তাবলীগের নিয়ম হল নিজে রেঁধে খাওয়া। প্রতিদিন দু'জনকে রাঁধবার দায়িত্ব দেয়া হবে। পরদিন আরো অন্য দু'জন। আজ আসাদ সাহেবের দায়িত্ব পড়লো। সাথে আরেকজন সাথী। কিন্তু দু'জনই অত্যন্ত আনাড়িমানের পাচক। জীবনে কক্ষনো রাঁধেননি। শলাপরামর্শ করে তারা রাঁধতে নামলেন। যোহরের পরপর রান্না শেষ হলো। পরিবেশন করা হল দু'জন 'শিশু' বাবুর্চির রান্না। প্রত্যেকেই নিঃশব্দে খেয়ে উঠলেন। যেহেতু তারা আজ রান্নার দায়িত্ব পেয়েছেন সেহেতু সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে তবেই তারা বসলেন। আসাদ সাহেব ভেবেছিলেন বোধহয় জব্বর রান্না হয়েছে। তিনি মনে মনে একটি নিভৃত রোমাঞ্চের অপেক্ষায় মুখে লোকমা তুললেন। ওয়াক থু! খাওয়া না ছাই! তিতা বিষ হয়েছে একদম! লবণের পরিমাণ কমপক্ষে দশগুণ বেশী! ঝালে মুখ পুড়ে যায়।
এ পর্যায়ে এসে আসাদ সাহেব মারাত্মক একটা ধাক্কা খেলেন। কিছু ধাক্কা মানুষকে অতলে, গহ্বরে ফেলে দেয়। আবার কিছু ধাক্কা মানুষকে ঠেলে ঠেলে আলোর দিকে এনে দেয়। আসাদ সাহেব দ্বিতীয়টিই খেলেন। একসময় তিনি মরিচের ইস্যু ধরে ধাক্কা মেরে স্ত্রীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই তিনিই এতজন লোককে অখাদ্য খাওয়ালেন। কেউ কোনো টু শব্দও করলো না। আসাদ সাহেব বুঝতে পারলেন, জীবনে তার অনেক কিছু শেখার বাকী আছে। জীবনে তাকে আরো ভালো হতে হবে।
--------
অফিসের টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। আসাদ সাহেব তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবী টুপি পরে অফিসের তৈয়ারী নিচ্ছেন। আজকাল তিনি সুন্নাতী লেবাসই পরেন। দাড়ি রেখেছেন। পূর্ণ মুসলমান ভাব।
নেহা জলদি করে চায়ের কাপ এনে টেবিলে রাখলো। আসাদ চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। নেহার কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলেন। এটা নেহার প্রতিদিনের টিপস। তার স্বামী অফিসে যাওয়ার সময় এবং আসার পর তাকে একটি করে চুমু দেয়। ভালোবাসায় নেহার ঘর মৌ মৌ করে সর্বোক্ষণ। 
স্বামীর চুমুক দেয়া কাপ নেহা হাতে নিলো। যেখানটায় আসাদ ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিয়েছেন নেহা ঠিক সেখানে ঠোঁট লাগিয়ে অবশিষ্ট চা'য়ে চুমুক দিল।  আস্তাগফিরুল্লাহ!!  এ কী করেছে নেহা?!   তাড়াহুড়োয় চা'য়ে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছে সে। কী উটকো স্বাদ! অথচ আসাদ এটাই তৃপ্তিকরে পান করলো। 
নেহা কাঁদছে। এ কান্না অবশ্যই দুঃখের না। আঠারো বছরের অত্যন্ত সুন্দরী তরুণীটি জীবনের প্রথম সুখের কান্না কাঁদছে। তার বড্ড ভালো লাগছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করলো, আরো দীর্ঘ হোক এ কান্না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...