ইমরান হুসাইন নাঈম
সুন্দর একটি বিকেলের অপমৃত্যু৷
বিকেলটা ছিলো অত্যন্ত মনোরম৷ মধ্যদুপুরে ঝরঝর করে এক পশলা বৃষ্টি পড়েছিল৷ ঝিরঝিরে বাতাস দেওয়া পাতাগুলো ভিজে শীতল হয়েছিল৷ ভেজা পাতার শরীরে পড়ছিল নরম রোদ্দুর৷ বাতাসে ছিল সোঁধা গন্ধ৷ আকাশে দৈত্যের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল তুলট মেঘ৷ এমন একটা ক্ষণ নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে কাটিয়ে দেয়া যায় কয়েকটা যুগ৷ হাসতে হাসতে বিদায় দেয়া যায় জমাটবাঁধা দুঃখগুলোকে৷ আর সেই তোমাকে ভেবে মনে মনে হেসে নেয়া যায় এক চোট৷
আমার কিন্তু এগুলোর কিছুই হলো না। বরং দুরন্ত মেঘগুলোর মতো আমার মনটাও হয়ে উঠল চনমনে। মন চাইলো পাল্লা দিই দমকা বাতাসের সঙ্গে।এবং সত্যি সত্যি দিয়েই দিলাম। এমন দিনে ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে নেই৷ অনেকদিন বাদে নানুবাড়ি এলাম৷ মামাতো ভাইদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম দুরন্তপনায়৷ নেমে গেলাম শৈশবের সেই ছোট্ট আমিতে৷ আসর নামায পড়েই নেমে পড়লাম খেলতে৷ টানা খেলে গেলাম৷ খেলতে খেলতে ক্লান্ত হলাম৷ ক্লান্ত হতে হতে আবারও খেললাম৷ মাগরিবের আগ মুহূর্তে উঠে এলাম ভদ্র সাজতে৷
মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম৷ তখনো অন্ধকার নেমে আসেনি৷ দূরে দূরে আবছা হয়ে আসছে৷ তবে পথ চলা যাচ্ছে পরিস্কার৷ মুখও চেনা যায় ঠিকঠাক৷ খোলা আকাশের নিচে আঁধার জমতেও সময় লাগে৷ এক মামাতো ভাইকে নিয়ে বের হলাম৷ বাজারে কিছু কাজ ছিল৷ গ্রামের রাস্তায় দিনের বেলায়ই গা ছমছম করে৷ রাতের কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে সারা শরীর৷ তিরতির করে কাঁপতে থাক প্রতিটা লোম৷ হুহ্ ! দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়৷
বাড়ির সামনে থেকেই অটো মেলে৷ তবে আঁধার হয়ে আসার সাথে সাথেই নীরব পথ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়৷ তখনো আলো আছে৷ তাই অটোর অপেক্ষা না করেই হাঁটা দিলাম আমরা৷ মোবাইল হাতে নিয়ে টুক টুক করে মেসেজ করে যাচ্ছিল মামাতো ভাই৷ হঠাৎ একদলা গোবরে ফসাৎ করে পা বসিয়ে দিল৷ ঢাকা হলে ম্যানহোলে পড়ত নির্ঘাত৷ কথাও চলছিল টুকটাক৷
কিছুক্ষণ পর হুড়হুড় শব্দে একটা অটো এল৷ আমরা তাতে চেপে বসলাম৷ আক্ষরিক অর্থেই চেপে চেপে বসতে হলো৷
কিছুক্ষণ পর হুড়হুড় শব্দে একটা অটো এল৷ আমরা তাতে চেপে বসলাম৷ আক্ষরিক অর্থেই চেপে চেপে বসতে হলো৷
অটোর মাঝখানের সিটে বসলাম আমি৷ ও বসল সামনে চালকের সঙ্গে৷ আমার পাশে ছিল একটা ফুটফুটে মেয়ে৷ বয়স বড়জোর আট কি নয়৷ ছোট বাচ্চা দেখলেই একটা পবিত্র পবিত্র ভাব আসে৷ মনে হয় পুরো পৃথিবীটা কত্ত সুন্দর৷ শিশুদের নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকালে হিমশীতল একটা পরশ বয়ে যায় হৃদয়ে৷ আমার সামনে বসা লোকটা শিশুটার সঙ্গে ছিল৷ এটা বুঝলাম যখন ওরা মাঝপথে নেমে গেল৷ কিন্তু এরপর যা দেখলাম৷ তা আমার সুন্দর দিনটাকে গলা টিপে মেরে ফেলল৷ মধ্যদুপুরের ঝুমঝুম বৃষ্টিকে মনে হলো গলিত শিশার বর্ষণ৷ অপমৃত্যু হলো একটি সুন্দর বিকেলের৷
লোকটার সঙ্গে একটা বোঝা ছিলো৷ অটো থেকে নেমেই ভারি বোঝাটা তুলে দিলো শিশুটার ছোট্ট মাথায়৷ বোঝার ভারে মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর৷ সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠলো৷ মনে চাচ্ছিল নেমেই দু'ঘা লাগিয়ে দিই ব্যাটার চোয়ালে৷ কিন্তু আমি পারি নি৷ তাই পারি নি নিজে ক্ষমা করতেও৷ চোখ বুঝলেই হৃদয়-পটে ভেসে ওটে শিশুটার কোমল মুখখানা৷ ভারি বোঝার চাপে দরদর করে ঘাম পড়ছে ওর সুন্দর মুখ থেকে৷ বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা বড় বেমানান লাগছে ওর সুন্দর কপালে৷ আমার ইচ্ছে হয়, ওকে কাছে এনে বসাই৷ রুমাল দিয়ে ওর ঘামগুলো মুছে দেই৷ আর জিজ্ঞেস করি, খুব কষ্ট হয়েছে তাই না!?

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন