বুধবার, ২ মে, ২০১৮

সফরনামা

সানাউল্লাহ তালুকদার


ক্ষনিকের তরে বন্দি হয়েছিলাম সাড়ে চারশো বছরের পুরানো কুতুবশাহী রাজবংশের কেল্লায়।
গোলকুন্ডা দুর্গ, হায়দারাবাদ, ইন্ডিয়া।

আসলে মানুষ বরাবরই রহস্যপ্রিয় হয়ে থাকে। প্রকৃতিতে রহস্যে মোড়া যেকোনো কিছুই রহস্যপ্রিয় মানুষকে চিরকাল তাড়া করে বেড়ায়। আর তাই রহস্যের খোঁজে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে পড়ে সেসব নানা ঐতিহাসিক স্থানের পানে, যেখানে জড়িয়ে রয়েছে অত্যাচার-বর্বরতা-হত্যা-শোষণ আর অভিশাপের অজানা সব কাহিনী।
 সেই রহস্যপ্রিয় মানুষদের ভিড়ের মাঝে নিজিকে হারিয়ে ফেলার মানুষিকতা থেকেই 
গত 25/02/2018 তে  কোনো এক বন্ধের দিনে অনুসন্ধিৎসু হৃদয়ের খোরাক দিতে আমরা সাত বন্ধু মিলে ( আসলে সবাই বন্ধু ছিলো না। তিনজন ছিল বড় ভাই তুল্য)  গোলকুন্ডা দুর্গে গিয়েছিলাম।

যাওয়ার আগে গুগলে সার্চ দিয়ে
দুর্গটির ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জেনে নিয়ে ছিলাম।

 এই দুর্গটি পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এমনই একটি ঐতিহাসিক স্থান। দুর্গটির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা অজানা কাহিনী। তার মধ্যে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক কাহিনী। সেই সঙ্গে (গাইডদের ভাষায়) যুক্ত হয়েছে কল্পনা মিশ্রিত গা ছমছমে কত গল্প। স্থানটিতে গেলে অন্তত সেরকম একটা শিউরে ওঠা অনুভূতি আপনি পেলেও পেতে পারেন। তার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক দুর্গটি প্রতিষ্ঠার কাহিনী।

উইকিপিডিয়ার ভাষায় গোলকুন্ডা দুর্গ ভারতের আন্দ্রা প্রদেশে অবস্থিত।1552-1687ইং) শাসনব্যবস্থা। হায়দ্রাবাদের পশ্চিম প্রান্তে ১১ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই দুর্গটি ভারতের সবথেকে সুন্দর কেল্লাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুর্গের ৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত হুসেন সাগর লেক। দুর্গটি নির্মাণে হিন্দু এবং মুসলিম দুই শাসকের ভূমিকা থাকায় দুর্গের স্থাপত্যশৈলীতে তার প্রভাব দেখা যায় প্রবলভাবে।

গোলকুন্ডা একসময় পরিচিত ছিল মানকাল নামে। ভারতের বিখ্যাত কাকাতিয়া রাজবংশের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এই দুর্গ। মুলত কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে কান্দাপল্লী দুর্গের সাথে নির্মিত হয় গোলকুন্ডা দুর্গটি। দুর্গটি একটি গ্রানাইট পাহাড়ের উপর নির্মিত। উচ্চতায় এটি ১২০ মিটার (৪৮০ ফুট), যার চারপাশে বাইরের শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো পরিখা। পরবর্তী সময়ে রানী রুদ্রমা দেবী এবং তার উত্তরাধিকারী প্রতাপারুদ্রের তত্ত্বাবধানে দুর্গটি পুনঃনির্মাণ করা হয় এবং এর ভিত আরো শক্ত করে গড়ে তোলা হয়।

এরপর মুসুনরি নায়েক তুঘলকী সেনাবাহিনীদের পরাজিত করে দুর্গের দখল নেন। ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুসুনরি নায়েকেরএকটি চুক্তির অংশ হিসেবে দুর্গটি বাহমানী সুলতানকে হস্তান্তর করা হয়। বাহমানী সুলতানের অধীনে দুর্গ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল। ঠিক এ সময় তেলঙ্গানার গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলককে (১৪৮৭-১৫৪৩)। ১৫০১ সালের দিকে তিনি গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব নেন।

বাহমানী সুলতানের সামাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলে সুলতান কুলি কুতুব শাহ ১৫৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তেলঙ্গানার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোলকুন্ডা দুর্গকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় কুতুব শাহী রাজবংশের সাম্রাজ্য। ৬২ বছরে কুতুব শাহী রাজবংশের প্রথম তিন সুলতান দুর্গটি সম্প্রসারিত করেন। বর্তমানে দুর্গটির যে গঠনশৈলী তা এই তিন সুলতানের অবদান।

অান্দ্রা প্রদেশের এ অঞ্চলে রয়েছে একাধিক কয়লাখনি। বহু হীরের সন্ধান দিয়েছে এই অঞ্চল। শুধু তা-ই নয়, বিখ্যাত কোহিনুর হীরের সন্ধানও মিলেছিল এই অঞ্চলে। যেখানে হীরে আছে, সেখানে লোভের ছায়া পড়বে না, তা কি কখনো হতে পারে? খনির নিচ থেকে আশ্চর্য অমূল্য রত্ন হীরের সন্ধান যেমন পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি এ দুর্গকে ঘিরেও জড়িয়ে রয়েছে নানা অভিশপ্ত কাহিনী। শোনা যায়, এ গোলকুন্ডা দুর্গে রচিত হয়েছিল এক ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। এমন কি ঘটেছিল এখানে যার জন্য এখনো ভৌতিক আবেশ রয়ে গিয়েছে এ দুর্গে!!!

অনলাইন থেকে দুইটি ওলা টেক্সিক্যাব ভাড়া করে মাদ্রাসার গেইট থেকে রওয়ানা হই। নাজেম সাহেব হুজুর আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন,  ‘‘বাচ্চে,  যাহাঁভি যাও,  শাম হোনেকি পেহলে আযা না। আমরা বললাম, (হায়দারাবাদি ভাষায়, এখানে হিন্দি এবং তেলেগু দুইটি ভাষা চলে)  হযরত  পেরেশানি নাক্কো করিয়ে (চিন্তা কইরেন না) হাম লোগ শামকি পেহলে আযায়েঙ্গে,....। হুজুর খুভ উদার মনের এবং মজার একজন মানুষ। যাই হোক আমরা দোয়া পড়ে গাড়ি নিয়ে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতে ড্রাইবারের সাথে ভালো একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো। তার সাথে  হিন্দি, বাংলা, ইংলিশ এবং মাঝেমাঝে ট্রান্সলেট এ্যপের সাহায্যে দু'একটা তেলেগু শব্দ মিলিয়ে  ডাল-খিচুরি পাকিয়ে কথা বলি। আর যেগুলি  শব্দ দ্বারা বুঝাইতে অক্ষম হই সেগুলি ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে অনেক কথা বলি। লোকটার সাথে কথা বলে মনে হলো,  সে হায়দারাবাদের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। তার কাছ থেকে হায়দারাবাদের পুরানো ইতিহাসের অনেক কথাই শুনলাম।
সকাল নয়টা নাগাদ আমরা গিয়ে দুর্গের সামনে নামলাম। তারপর  তার ভাড়াটা চুকিয়ে তার থেকে বিদায় নিয়ে দুর্গের গেটের দিকে পা বাড়ালাম। গেটে গিয়ে ছিরিয়াল ধরে 20 রুপি দিয়ে টিকিট কিনে দুর্গের ভিতরে ডুকলাম। ভিতরে গিয়ে একজন গাইডের মাধ্যমে পুরা দুর্গটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
ঘুরতে ঘুরতে যখন পাহাড়ের একদম চুড়ায় উঠলাম। তখন দেখলাম সেখানে একটা লোক ফোনে কথা বলতেছে। এবেডা,  মুই এহন কোম্মে জানো? মুই এহন এ্যাক্যালে পাহারের মাতায় আহাশের দারে দারে, 
খাছ বরিশালের ভাষায় তার কথা  শুনে সবাই কতক্ষন হাসাহাসি করলাম।
 ঘোরাঘুরি শেষ করে দুপুর তিনটা নাগাদ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসি।  তারপর দুইটি ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে মাদ্রাসায় চলে আসলাম ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...