"স্যার.." পিয়ন নাসিরের ডাকে একাউন্টেন্ট শফিক চোখ তুলে তাকায়।
"কি নাসির চাচা?"
"আমার একটু ছুটি লাগত.."
"ছুটি?"
"জে, সাত দিনের ছুটি।"
"এত দিন!"
"জে। আপনে হিসাব কইরা দেহেন আমার ষোল দিন ছুটি পাওনা আছে। যাইতাম না, বশিরের মা'র অসুখ.."
"ও চাচীর অসুখ? কোন গুড নিউজ আছে নাকি...হা হা হা।"
পিয়ন নাসির অপ্রস্তুত হয়। লিভ ফরমটা শফিক সাহেবের অনুমোদনের জন্য এগিয়ে দেয়। শফিক হাতে নেয়।
"কি নাসির চাচা?"
"আমার একটু ছুটি লাগত.."
"ছুটি?"
"জে, সাত দিনের ছুটি।"
"এত দিন!"
"জে। আপনে হিসাব কইরা দেহেন আমার ষোল দিন ছুটি পাওনা আছে। যাইতাম না, বশিরের মা'র অসুখ.."
"ও চাচীর অসুখ? কোন গুড নিউজ আছে নাকি...হা হা হা।"
পিয়ন নাসির অপ্রস্তুত হয়। লিভ ফরমটা শফিক সাহেবের অনুমোদনের জন্য এগিয়ে দেয়। শফিক হাতে নেয়।
"কিন্তু চাচা, অফিসে অডিট চলছে, কত্ত কাজ। এই সময় না গেলে হয় না?"
"না স্যার যাওন লাগবই। আপনে ছুটি না দিলেও যামু।" নাসির ক্ষেপে উঠে।
"আচ্ছা যাবেন, যাবেন। কিন্তু.. "
"আপনে চিন্তা কইরেন না। মফিজরে কইছি আপনেগো চা, বড় সাবের দুপুরের খাওন, ফটোকপি সব কইরা দিব।"
"তাহলে ঠিক আছে। যাবেন কবে?"
"আইজ রাইত।"
"হুম, আমি একটু স্যারের কাছে জেনে আসি।"
শফিক বড় সাহেবের রুমে যায়। ও জানে বড় সাহেব নিষেধ করবেন না। নাসির চাচা এ অফিসের সবথেকে পুরাতন বয়স্ক কর্মচারী। বড় সাহেবের অনুমোদন, জাষ্ট ফর্মালিটি।
শফিক সাহেব বড় স্যারের রুমে ঢোকা থেকে বের হওয়া পর্যন্ত নাসির দরজার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। ও সাধারণত ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যায়। এবারই ব্যতিক্রম কারণ ছেলে বশির ফোন দিয়েছিল;
"বাজান মা'র শরীরটা ভাল না। জ্বর। আলেয়ার মায় কইছে ডেঙ্গু হইবার পারে। তুমি কয়ডাদিন ছুটি নিতে পারবা না?"
"অফিসে এত কাম.."
"কাম সারাজনমই ত করলা।... আমিই যাইতাম। আমার সাবে গেছে বিদেশ। ম্যাডাম কইছে.."
"বাজান মা'র শরীরটা ভাল না। জ্বর। আলেয়ার মায় কইছে ডেঙ্গু হইবার পারে। তুমি কয়ডাদিন ছুটি নিতে পারবা না?"
"অফিসে এত কাম.."
"কাম সারাজনমই ত করলা।... আমিই যাইতাম। আমার সাবে গেছে বিদেশ। ম্যাডাম কইছে.."
বয়োবৃদ্ধ নাসিরের মনটা উদাস হয়। মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে বাড়িতে চলে যায়। এখন জীবনের বাকী কয়টাদিন বুড়াবুড়ি মিলে কাটিয়ে দিবে। অনেক তো হলো আর কত? আজ বছর বিশেক হবে নাসির এই অফিসে কাজ করছে। বড় সাহেবের আব্বা যখন এই অফিস খোলে সেই তখন থেকে। গত ঈদেও এই একই উদ্দেশ্যে বাড়ি গিয়েছিল। বেশিদিন থাকতে পারে নাই। শফিক সাহেব ফোনের পর ফোন। আর ওইদিকে ঢাকায় ফেরার কথা শুনেই বশিরের মা'র মুখ বেজার। একদিন তো না খেয়েই ছিল। এরপর শেষে বড় সাহেবের ফোন পেয়ে বাধ্য হয়ে চলে এসেছে। আসলে ওকে ছাড়া ওরা চলবে কিভাবে? হেন কাজ নেই ও করে না। অফিস ঝাড়পোছ থেকে শুরু করে, খাওয়া-দাওয়া, আপ্যায়ন, ব্যাংকে যাওয়া, কেনা কাটা, ফটোকপি, চিঠি পোস্ট করা, অফিস খোলা বন্ধ করা আরও কতকি। এছাড়াও আছে বন্ধের দিনে বড় সাহেবের বাসায় বাজার করা, উনার ছেলেকে নিয়ে এদিক সেদিক যাওয়া। নাসির বলেছে, 'আমি আরেকটা ছেলে দেই।' বড় সাহেব রাজী হননি। 
শফিক সাহেব বের হয়ে আসে। বলে, "চাচা আপনাকে স্যার ডাকে।"
নাসির বড় সাহেবের রুমে ঢুকতে সাহস হারায়। শফিক সাহেবের পিছু নেয়। বলে, "সাবে কি কইছে? আমারে যাইতে দিব না? এইবার ছুটি না দিলেও আমি যামু। কত্ত কইলাম একটা পোলা আইনা দেই, না আমার কথা শুনত না। আমি কি কাম করতে করতে মইরা যামু? আমার কি বাড়িঘর নাই...."
নাসির বড় সাহেবের রুমে ঢুকতে সাহস হারায়। শফিক সাহেবের পিছু নেয়। বলে, "সাবে কি কইছে? আমারে যাইতে দিব না? এইবার ছুটি না দিলেও আমি যামু। কত্ত কইলাম একটা পোলা আইনা দেই, না আমার কথা শুনত না। আমি কি কাম করতে করতে মইরা যামু? আমার কি বাড়িঘর নাই...."
নাসির গোমড়ামুখে নিজের টুলে বসে থাকে আর খানিক পর পর বকবক করতে থাকে। শফিক সাহেব নিজের কাজে ডুবে যান। এরপর লাঞ্চের আগ পর্যন্ত নানা লোক আসে। নাসিরের ব্যস্ততাও বাড়ে। চঞ্চল সাহেব আসেন, বড় সাহেবের রুমে যান। নাসির চা দিয়ে আসে। কিন্তু বড় সাহেব কিছু বলেন না। নাসিরেরও মন ভার থাকে সারাদিন। নাসির অফিসের কাজে বাইরেও যায় বেশ কয়বার। এরই মাঝে গার্ড মফিজ আর ড্রাইভার ইদ্রিসের সাথে দুঃখের প্যাঁচাল পাড়ে। কিন্তু ওরা আর কিইবা করতে পারে নাসির চাচার সাথে সহানুভূতি দেখানো ছাড়া। নাসির ঠিক করে, ছুটি না দিলেও ও আজ রাতেই লঞ্চে উঠবে। যা হওয়ার হবে। 'চুরিতো আর করি নাই যে বাইন্দা রাখব!'
সন্ধ্যায় বড় সাহেবের রুমে ডাক পড়ে। ও ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। 
"চাচা, কী খবর? চাচীর নাকি শরীর খারাপ?"
নাসির কিছু বলে না।
"শুনেন, আপনাকে মা একটু দেখা করতে বলছে। অফিসের চাবীটা শফিক সাহেবকে দিয়ে আমার সাথে বাসায় চলেন।" বড় সাহেব উঠে দাঁড়ান। নাসির এগিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারের হাতে দেয়।
"চাচা, কী খবর? চাচীর নাকি শরীর খারাপ?"
নাসির কিছু বলে না।
"শুনেন, আপনাকে মা একটু দেখা করতে বলছে। অফিসের চাবীটা শফিক সাহেবকে দিয়ে আমার সাথে বাসায় চলেন।" বড় সাহেব উঠে দাঁড়ান। নাসির এগিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারের হাতে দেয়।
শফিক সাহেবের কাছে যেতেই উনি অফিসের চাবিটা নিয়ে নেন। আর একটা খাম এগিয়ে বলেন, এইটা স্যারের হাতে দিবেন।
গাড়িতে নাসির সামনে বসে। বড় সাহেবের হাতে শফিক সাহেবের দেয়া খামটা দেয়। উনি ফোনে কার সাথে কথা বলছিলেন। নাসির সুযোগ খুঁজতে থাকে ওর প্রয়োজনীয় কথাটা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ আর পায় কই?
গাড়িতে নাসির সামনে বসে। বড় সাহেবের হাতে শফিক সাহেবের দেয়া খামটা দেয়। উনি ফোনে কার সাথে কথা বলছিলেন। নাসির সুযোগ খুঁজতে থাকে ওর প্রয়োজনীয় কথাটা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ আর পায় কই?
বড় সাহেবের বাড়িতে নাসির চাচা প্রিয়মুখ। বড়সাহেবের মা একটা বড় প্যাকেট হাতে দেন। বলেন, "নাসির তোমার বউর জন্য একটা শাড়ি আর সাবান-টাবান হাবিজাবি আছে। আর এই টাকাটা রাখ।"
ম্যাডাম আরেকটা প্যাকেট দিয়ে বলেন, "চাচা আপনার নাতনী এবার দশে পড়েছে না? ওর জন্য কয়টা শীতের জামা। আর ওর মা'র জন্য একটা থ্রি-পিস। নেন ধরেন।"
শেষে বড় সাহেব বলেন, "চাচা আপনাকে ছেড়ে দিতেতো মনে চায় না। কিন্তু চাচীর যেহেতু অসুখ...শোনেন উনাকে এইবার ঢাকা নিয়ে আসবেন। আমার বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবো। বড় ডাক্তার দিয়ে চেক-আপ করিয়ে দিব। আর এই নেন আপনার বেতন আর কিছু অগ্রিম টাকা। বাড়ির জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাবেন।..."
এই উদারতা আর এত মহানুভবতা নাসিরের চোখে আপনাতেই পানি আনে।
"কা...কা কা..."
"এই..হুস হুস.." রহিমা উঠোনে বসে তার পানের বাটাটা সাজাচ্ছিল। সে হাতের কাছের কঞ্চিটা দিয়ে কাকটা তাড়াতে সচেষ্ট হয়।
"কিগো চাচী আইজ অতিত আইব মনে কয়।" 
পাশের বাড়ির মর্জিনা প্রতিদিন দুপুরে মাথা বিলি দিতে এ বাড়িতে আসে। ও আর বশিরের বউ নারকেল গাছটার নিচে ছায়ায় বসা। ওর কথা শুনে বশিরের বউ মর্জিনার গায়ে চিমটি কাটে। 
পাশেই রহিমার নাতনী আলেয়া একটা বাক্সে ওর পুতুলের ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ও এ সময় গেয়ে উঠে,
"হাইসো নাগো তোমরা, বুড়ায় আমায় মারিছে
বুড়ায় আমায় মারিছে, কোমড় আমার ভাঙ্গিছে
সেই ভাঙ্গা কোমড়ে আবার বিছা পড়াইছে।
হাইসো নাগো তোমরা..."
বুড়ায় আমায় মারিছে, কোমড় আমার ভাঙ্গিছে
সেই ভাঙ্গা কোমড়ে আবার বিছা পড়াইছে।
হাইসো নাগো তোমরা..."
রহিমা কঞ্চিটা নিয়ে ওকেও তাড়া করে। আলেয়া লাফিয়ে সরে যায়। একটু দূরে গিয়ে আবারও নেচে নেচে গাইতে থাকে। বশিরের বউ আর মর্জিনা হাসতে হাসতে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়ে।
আর বেরসিক কাকটা যেন ইচ্ছে করেই তারস্বরে চেঁচাতে থাকে, "কা..কা কা.."
nazibulalam@gmail.com
 

 
 
 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন