সাইমুনা তারিন
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ। এবার অফিস থেকে বেরিয়ে পড়বে, ভাবছে আবরার। ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল সে। সারাদিন কাজের পর মলিন মুখ করে ফিরতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আজ একটা স্পেশাল প্ল্যান আছে। আজ কুলি কামিনের চেহারা নিয়ে বেরুনো যাবে না। খানিক আগে একবার ভাল করে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল। তারপর এক কাপ চা খাওয়ায় চেহারায় ক্লান্তির ছাপটা একদম নেই এখন। বের হবার মুখেই নায়লার ফোন এলো। ফোনের স্ক্রিন জুড়ে ওর হাসিমুখের ছবি।
'হ্যালো নায়লা, আমি বের হচ্ছি।'
'ওকে। কতক্ষণ লাগতে পারে?'
'তা কি ঠিক করে বলা সম্ভব? ঢাকা শহরের জ্যামের কথা তো জানো। নাবা রেডি হয়েছে?'
'কমপ্লিটলি। ওয়েট করছে কখন ওর বাবা আসবে!'
'আচ্ছা আমি তাহলে ছাড়ছি।'
নীচে নেমে একটা রিকশা নিয়ে নিল আবরার। গাড়ি আছে তার, কিন্তু ওটা নায়লার দখলেই থাকে। ওর নয়টা পাঁচটা অফিস। তাছাড়া নাবাকে স্কুলে ড্রপ করা এবং স্কুল
থেকে পিক করা এগুলি ওর দায়িত্ব। তাই আবরার গাড়িটা নায়লার জন্য ছেড়ে দিয়ে রেখেছে। গাড়ির দামও অর্ধেক শেয়ার করেছে নায়লা। ড্রাইভারের বেতনটাও ওর ফান্ড থেকে যায়। এসব নিয়ে আবরারের তেমন কোন দু:খবোধ নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে সে মোটামুটি সুখেই আছে। শুধু একটাই সমস্যা। নায়লার সংগে তার মায়ের বনিবনা হয় না। ভদ্রমহিলা নায়লাকে কোন অধিকার দেন না। মা'র নিয়ম অনুযায়ী ওদের সংসার চলে। ওখানে নায়লার কোন দখল নেই। নায়লাও মা'কে সহ্য করতে পারে না। পড়াশোনা জানা মোটা মাইনের চাকরি করা বউ। কাজেই নায়লাও সামান্য পড়াশোনা জানা শ্বাশুড়িকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাই মাঝে মাঝেই দু'জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। আবরারের তখন উভয় সংকট চলতে থাকে। নায়লার সংগে তার বিয়ে হয়েছে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে। কাজেই ওকে বেশিকিছু বলাও যায় না। বললে মান অভিমান, কথা শোনানো আরো নানান অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। আবরারের এইসব ভাল লাগে না। তাছাড়া বউকে সে খানিকটা ভয়ও পায়, যা অনেক পুরুষই পায়। বউ মাথা গরম করে তাকে ছেড়ে চলে গেলে কত সমস্যা। লোকজন হাজার কথা বলবে, আত্মীয় পরিজনদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, বউ এর কাছ থেকে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো ছাড়াও আরো দু'টো জোরালো কারণ আছে। এই বউ ছেড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। এক্কেবারে উথাল পাথাল না হলেও বউ এর জন্য তার মনে যেটুকু প্রেম আছে সেটুকু একজীবন এক সংগে কাটিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় কারণটা হল, নাবাকে সে কোন ব্রোকেন ফ্যামিলির চিত্র দেখাতে চায় না। যেকোন মূল্যে মেয়েকে সে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চায়।
বেইলি রোডে একটা শর্মা হাউজ হয়েছে কিছুদিন হল। এখানকার শর্মাটা ভাল। কেন জানি নাবা এখানে খেতে খুব ভালোবাসে। মেয়ের জন্যই এখানে আসা। তার অফিস ছিল প্রেস ক্লাবে। সেখান থেকে রিকশায় বেইলি রোড পর্যন্ত আসতে পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগলো। ভাড়া চুকিয়ে আরেকবার নায়লাকে ফোন দেবে বলে মোবাইল বের করতেই মা'র ফোন বাজল।
'হ্যালো আম্মা।'
'কখন ফিরবি?'
'একটু দেরি হবে।'
'এখনো অফিসে?'
'না। আমি বের হয়েছি, একটু কাজ আছে। আরো দেড় দুই ঘন্টা লেগে যাবে বাসায় ফিরতে।'
'ও আচ্ছা।'
'তোমার কিছু লাগবে?'
'না, কিছু লাগবে না।'
আবরার মা'কে বলতে পারল না সে বউ আর মেয়েকে নিয়ে খেতে এসেছে। এসব খাবারে মা'র কোন আগ্রহ নেই, তবু কথাটা বলতে মুখে আটকালো। সবসময়ই এরকম হয়। তারা কোথাও বেড়াতে গেলে বা খেতে গেলে মা'কে বলা হয়ে ওঠে না। তার কেমন যেন মুখে বাধো বাধো ঠেকে। মনের কোণে অপরাধবোধের কাদা লেগে থাকে। যদিও সে জানে, মা'কে বললেই তাদের সাথে বেরিয়ে পড়বেন এমন মানুষ তিনি নন। সংসারের চার দেয়ালে থাকতেই ভালবাসেন তিনি। বাবা মারা যাবার পর থেকে নিজেকে আরো বেশি বন্দি করে নিয়েছেন। ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও না যাবার নানান বাহানা খুঁজতে থাকেন। সাথে না নিয়ে গেলেও মা'র জন্য খাবার পার্সেল করে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু নায়লা তাতে বিরক্ত হবে ভেবে সেটা করতে পারে না।
মা'র ফোন রেখে নায়লাকে কল দিতে জানা গেল ওরা ইতিমধ্যে ভেতরে বসে অপেক্ষা করছে। ওপরে উঠে একটু খুঁজতেই ওদের পেয়ে গেল আবরার। মা মেয়ে মুখোমুখি ছোট একটা টেবিল দখল করে বসেছে। আবরার এসে বসল মেয়ের পাশে। নাবা তাকে হাগ করে বলল, 'আই লাভ য়্যু বাবা।'
'লাভ য়্যু টুউ। কি খাবে, বলো? অর্ডার করা হয়েছে?' শেষের প্রশ্নটা নায়লার উদ্দেশ্যে।
'তোমার জন্য ওয়েট করছি। আমি পাস্তা খাব। নাবা বোধহয় শর্মাই খেতে চায়।'
'আমার বাবা কি খাবে?' আবরার মেয়ের দিকে ফিরল।
'শর্মা।'
'ওকে। আমিও শর্মা খাব।' সে ওয়েটার কে ডাকল।
তিনজনে গল্প করে খেতে খেতে দেড় ঘন্টা। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা। বিল মিটিয়ে ওঠার মুহুর্তে নাবা বলল, ' বাসায় গিয়ে কি আমরা ডিনার করব, বাবা?'
'তোমার যদি ইচ্ছে করে ডিনার করতে, তাহলে করবে।'
'হুম। তুমি?'
'আমিতো ঘুমাব আরো তিন ঘন্টা পর। ততক্ষণে হয়ত একটু কিছু খেতে ইচ্ছে করবে।'
ওরা মা মেয়ে কিছু খাক বা না খাক, আবরার জানে তাকে কিছু খেতেই হবে। তা নইলে মা'র কাছে ধরা পড়তে হবে। নায়লা ওসব কেয়ার করে না। একটা কিছু বলে দেয় মুখের ওপর। তাছাড়া মা খাবার আগলে বসে থাকে, কেউ না খেলে ব্যাপারটা খুব বিচ্ছিরি দেখায়।
ঢাকা শহরের জ্যাম বলে কথা। গাড়িতে চড়ে দশ পনের মিনিটে যে রাস্তা পাড়ি দেয়া যায়, সেটুকু পাড়ি দিতে ওদের আধঘণ্টার বেশি লাগল। গাড়ি এসে থামা মাত্র আবরার দেখল ফোন বাজছে। হাতে নিয়ে দেখল, তার ছোট বোনের নাম্বার।
'হ্যাঁ মুনিয়া, কি খবর?'
'তুমি কোথায় ভাইয়া? কতবার ফোন দিলাম?'
আবরারের মনে হল মুনিয়া কান্না চেপে রেখে কথা বলছে। সে খানিকটা বিচলিত হল।
'কেন রে? কোন সমস্যা নাকি? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? রিং তো শুনতে পাইনি, রাস্তায় জ্যাম, গাড়ির হর্ন। আমি আমাদের বাসার সামনে। এখনি ঢুকব।'
'আসো।' মুনিয়া লাইন কেটে দিল।
আসো মানে কি? মুনিয়া তো এ বাসায় থাকে না। ওর বাসা উত্তরা। জয়েন্ট ফ্যামিলি ওদের। আজ সকালেও তো মুনিয়া আসবে বলে শোনে নি। মা'র সংগে সন্ধ্যায় কথা হল, তখনো মা মুনিয়ার কথা কিছু বলেন নি। গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকলে আবরার চট করে নেমে পড়লো।
'তোমরা আসো আস্তে আস্তে। আমি যাচ্ছি। মনে হচ্ছে বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে।'
নায়লা একবার তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো, কিছু বলল না। আবরাররা পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে থাকে। লিফট এর তোয়াক্কা না করে সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে গেল। দরজার বেল বাজাতে হল না, হাত দিয়ে একটু ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু এ কি! পাশের বাসার লোকজন এখানে কেন? মুহূর্তেই মুনিয়াকে দেখতে পেল আবরার। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
'কতবার ফোন দিলাম তোমাকে, একটাবার যদি রিসিভ করতে! সব শেষ, ভাইয়া! সব!'
আবরার কেমন বিচলিত বোধ করতে থাকে। বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কি সমস্যা বুঝে উঠতে পারে না।
' কি হয়েছে? কি শেষ?' সে বোনের মাথায় হাত রাখে।
' মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে ভাইয়া। আর কোনদিন আসবে না!' মুনিয়া হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
আবরার টের পায় তার শরীরটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না। বোনের কথাগুলি তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিছুক্ষণ আগেই না সে তার মার সাথে কথা বলেছে! দরজার মুখে সে দাঁড়িয়েই থাকে, ভেতরে যাবার সাহসও হয় না। একসংগে অনেকগুলি প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে কিন্তু কোনটা রেখে কোন প্রশ্নটা করবে তাও সে বুঝতে পারে না।
'আসো, ভেতরে চলো।' মুনিয়া চোখ মুছে ভাইকে মা'র শোবার ঘরের দিকে নিতে চাইলো। কিন্তু আবরার বসার ঘরেই বসে পড়ল। আর কোথাও যাবার মত শক্তি এখন তার শরীরে নেই।
এসময় নাবা আর নায়লা ভেতরে ঢুকলো। তারাও পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন দেখে হতচকিত। পাশের ভদ্রমহিলা নিজেই এসে নায়লাকে খবরটা দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মা'র সাথে নাবাও গেল।
আবরার মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পাশে মুনিয়া।
'হঠাৎ মা বললো শরীর খারাপ লাগছে। বসে ছিল শুয়ে পড়লো। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে...। চারতলার যে মেয়েটা ডাক্তারি পড়ে, ও এসে দেখে গেল। বললো সব শেষ হয়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে কোন লাভ নেই। তবু আমরা চাইলে নিতে পারি। অন্যান্য মহিলারাও এসে একই কথা বললো।'
'তুই কখন এসেছিস?'
'বিকালে। আমার কেন জানি সকাল থেকে মনটা কেমন কেমন করছিল। মা'কে খুব মিস করছিলাম। তাই ঠিক করলাম দুপুরে খেয়ে এদিকে আসব। এসে তো দেখলাম সব ঠিকঠাক কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হল! তাও ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম, নইলে মা অমন একলা ঘরে.....।' মুনিয়া কথা শেষ করতে পারল না, আবার কান্নার দমকে তার কথা আটকে গেল।
আবরার কাঁদতে পারছেনা। পুরুষ মানুষ কারো সামনে কাঁদে না এরকম কিছু ভেবে নয়, তার কান্নাই আসছে না। সমস্ত অনুভূতি যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে। কোনটা থেকে কোনটা আলাদা করতে পারছে না সে। ছোটবেলায় কোনদিন মা'কে না বলে স্কুলে চলে গেলে পরে সারাদিন মনটা খুঁতখুঁত করতো, যেন কিছু জরুরি কাজ বাদ পড়ে গেছে, সব কাজের ফাঁকে বারবার মনে হত, কি যেন নেই কি যেন নেই! কোথায় যেন একটা বিরাট শূন্যতা। এই মুহূর্তে ঠিক সেরকমই শূন্য মনে হচ্ছে। এক লহমায় মাঝখানের এতগুলি বছর মিলিয়ে গিয়ে তাকে আবার সেই স্কুলের ছোট্ট ছেলেটি করে দিলো স্মৃতিরা। মনে হলো কিছুক্ষণ পরেই মা'র কাছে ফিরে যাওয়া যাবে, তখন আর এই দু:স্বপ্ন থাকবে না।
নায়লাকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য অনেক ছাড় দিয়েছে আবরার। এই ছাড়গুলোর একটা হলো নায়লা মাঝে মাঝে মা'র সংগে খারাপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও ওকে শাসন করে নি সে। মা'কে না জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে এবং পরে বাচ্চাসহ বাইরে বাইরে মজা করে বেড়িয়েছে, হয়তো সংসারের বা মা'র একটা কাজ করে দেয়া হয় নি। বিশেষ করে বাবার অবর্তমানে যা তারই দায়িত্ব ছিল। বিয়ের পর মা'র সংগে বসে দু'দন্ড সময় কখনো কাটানো হয় নি অথচ মা মুনিয়ার চেয়ে যেন তাকেই বেশি ভালোবেসেছেন আজীবন। আজ মা'র মৃত্যুকালে মুনিয়ার মন কেমন কেমন করায় ও হুট করে মা'কে দেখতে চলে এসেছে, আর সে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে সুখের ভেলায় ভেসেছে। মুনিয়া বারবার তাকে ফোন করেছে মা'র চলে যাবার মুহূর্তে, সেই ফোনের রিং পর্যন্ত সে শুনতে পায় নি। নাহ, সে অন্যায় হয়তো কিছুই করে নি, কিন্তু মা'র সাথে তার আত্মিক বন্ধনটার অভাব ছিল, যা মুনিয়ার ছিল না!
মা'র জন্য কিছুই করতে পারে নি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব সুযোগ হেলায় হারিয়েছে এই বোধটা আবরারকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। এইসব কথা সে কখনো নায়লাকে বলবে না, মুনিয়াকেও না। নিজের মধ্যেই ভীষণভাবে দগ্ধ হতে থাকবে দিনের পর দিন, কে জানে হয়তো সারাজীবন। মা'র কাছে একবার ক্ষমা পর্যন্ত চাওয়ার কথা তার মাথায় আসে নি একটিবারের জন্য!
পরদিন সকাল দশটার মধ্যে মা'র দাফন শেষ হয়ে গেল। ছোটবেলায় মা'র মুখেই শুনেছে নানাভাইয়ের জন্য দুআ করছে, রাব্বির হামহুমা ক্বামা রাব্বাইয়ানি সাগীরা [হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন পালন করেছেন। (আল কুরআন, ১৭:২৬)]। এই দুআ সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই পড়তে থাকলো। মুনিয়া কয়েকদিন থাকবে, শ্বশুরবাড়িতে বলা আছে। এতে আবরার যে কি খুশি হয়েছে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মা'র জায়গাটা কাউকে দিয়ে ভরবে না সে জানে, তবু বোনটা কাছে থাকলে যেন নিজের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়। সে নিজেও দু'দিন ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। বাবা মারা যাবার পর মা তাদের দুই ভাই বোনকে আগলে রেখেছিলেন, এমন করে বাবার অভাবটা টের পায় নি কখনো। কিন্তু মা যে এত আলাদা, সারাজীবন যা শুনে এসেছে, আজ হাড়ে হাড়ে সেটা বুঝতে পারছে।
আসর এর নামাজ এর পর ইমাম সাহেবের সাথে কথা হচ্ছিল মসজিদের বাইরে। মা'র খবরটা তিনি জানেন। তাছাড়া মাঝে মাঝেই আবরারের সাথে কথা বলেন তিনি, পাড়ার মধ্যেই থাকেন বলে জানাশোনা আছে। জুমআ'র নামাজ আবরার এই মসজিদেই পড়ে ফেলে। মসজিদের রেনোভেশানের কাজ শুরু হবে সামনের মাসে, তখন স্বল্প পরিসরে জামায়াত হবে, ইমাম সাহেব বলছিলেন।
'বুঝলে আবরার, এই ক'টা দিন হয়তো জামায়াতে মুসল্লি খুব একটা হবে না। তাও চালিয়ে তো যেতেই হবে।'
'তা তো বটেই।'
'আর অনেক টাকার দরকার। আজকাল ইট, বালু, সিমেন্টের যা দাম বোঝই তো। মসজিদের ফান্ডে এত টাকা নেই। কিছু ডোনেশান অবশ্য পেয়েছি, তবে আরো অনেক দরকার। আর তাছাড়া সবার টাকা নেয়াও যায় না! কার কতটা সৎ উপার্জন নিশ্চিত করে তো বলা যায় না।'
আবরারের মনে হলো, আল্লাহ্ তাকে একটা পথ দেখাচ্ছেন, যার উৎস সে গতকাল থেকে মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
'আমি কিছু টাকা এই কাজের জন্য সাদাক্বা করতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?'
ইমাম সাহেব খুশি হয়ে হাসলেন, 'এটা তো সুখবর যে তুমি সাদাক্বা করতে চাও। তোমার সততা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আপত্তি থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।'
'এই টাকাটা আমি আমার মা'র জন্য দিতে চাই। মা'র জন্য সারাজীবন কিছুই করতে পারি নি!'
'ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি কবুল করে নিন।'
'আমি কাল পরশুর মধ্যে আপনাকে চেক দিয়ে যাব। ফান্ডের দায়িত্বে যারা আছে, তাদের মধ্যে আপনিও তো একজন।'
'হ্যাঁ। ঠিক আছে, তোমার যেমন ইচ্ছে।'
আবরার ইমাম সাহবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলো। তার দু'চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। সামনের পথটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। কিন্তু তার মনের ভারটা অনেক কমে গেছে।
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ। এবার অফিস থেকে বেরিয়ে পড়বে, ভাবছে আবরার। ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল সে। সারাদিন কাজের পর মলিন মুখ করে ফিরতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আজ একটা স্পেশাল প্ল্যান আছে। আজ কুলি কামিনের চেহারা নিয়ে বেরুনো যাবে না। খানিক আগে একবার ভাল করে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল। তারপর এক কাপ চা খাওয়ায় চেহারায় ক্লান্তির ছাপটা একদম নেই এখন। বের হবার মুখেই নায়লার ফোন এলো। ফোনের স্ক্রিন জুড়ে ওর হাসিমুখের ছবি।
'হ্যালো নায়লা, আমি বের হচ্ছি।'
'ওকে। কতক্ষণ লাগতে পারে?'
'তা কি ঠিক করে বলা সম্ভব? ঢাকা শহরের জ্যামের কথা তো জানো। নাবা রেডি হয়েছে?'
'কমপ্লিটলি। ওয়েট করছে কখন ওর বাবা আসবে!'
'আচ্ছা আমি তাহলে ছাড়ছি।'
নীচে নেমে একটা রিকশা নিয়ে নিল আবরার। গাড়ি আছে তার, কিন্তু ওটা নায়লার দখলেই থাকে। ওর নয়টা পাঁচটা অফিস। তাছাড়া নাবাকে স্কুলে ড্রপ করা এবং স্কুল
থেকে পিক করা এগুলি ওর দায়িত্ব। তাই আবরার গাড়িটা নায়লার জন্য ছেড়ে দিয়ে রেখেছে। গাড়ির দামও অর্ধেক শেয়ার করেছে নায়লা। ড্রাইভারের বেতনটাও ওর ফান্ড থেকে যায়। এসব নিয়ে আবরারের তেমন কোন দু:খবোধ নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে সে মোটামুটি সুখেই আছে। শুধু একটাই সমস্যা। নায়লার সংগে তার মায়ের বনিবনা হয় না। ভদ্রমহিলা নায়লাকে কোন অধিকার দেন না। মা'র নিয়ম অনুযায়ী ওদের সংসার চলে। ওখানে নায়লার কোন দখল নেই। নায়লাও মা'কে সহ্য করতে পারে না। পড়াশোনা জানা মোটা মাইনের চাকরি করা বউ। কাজেই নায়লাও সামান্য পড়াশোনা জানা শ্বাশুড়িকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাই মাঝে মাঝেই দু'জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। আবরারের তখন উভয় সংকট চলতে থাকে। নায়লার সংগে তার বিয়ে হয়েছে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে। কাজেই ওকে বেশিকিছু বলাও যায় না। বললে মান অভিমান, কথা শোনানো আরো নানান অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। আবরারের এইসব ভাল লাগে না। তাছাড়া বউকে সে খানিকটা ভয়ও পায়, যা অনেক পুরুষই পায়। বউ মাথা গরম করে তাকে ছেড়ে চলে গেলে কত সমস্যা। লোকজন হাজার কথা বলবে, আত্মীয় পরিজনদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, বউ এর কাছ থেকে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো ছাড়াও আরো দু'টো জোরালো কারণ আছে। এই বউ ছেড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। এক্কেবারে উথাল পাথাল না হলেও বউ এর জন্য তার মনে যেটুকু প্রেম আছে সেটুকু একজীবন এক সংগে কাটিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় কারণটা হল, নাবাকে সে কোন ব্রোকেন ফ্যামিলির চিত্র দেখাতে চায় না। যেকোন মূল্যে মেয়েকে সে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চায়।
বেইলি রোডে একটা শর্মা হাউজ হয়েছে কিছুদিন হল। এখানকার শর্মাটা ভাল। কেন জানি নাবা এখানে খেতে খুব ভালোবাসে। মেয়ের জন্যই এখানে আসা। তার অফিস ছিল প্রেস ক্লাবে। সেখান থেকে রিকশায় বেইলি রোড পর্যন্ত আসতে পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগলো। ভাড়া চুকিয়ে আরেকবার নায়লাকে ফোন দেবে বলে মোবাইল বের করতেই মা'র ফোন বাজল।
'হ্যালো আম্মা।'
'কখন ফিরবি?'
'একটু দেরি হবে।'
'এখনো অফিসে?'
'না। আমি বের হয়েছি, একটু কাজ আছে। আরো দেড় দুই ঘন্টা লেগে যাবে বাসায় ফিরতে।'
'ও আচ্ছা।'
'তোমার কিছু লাগবে?'
'না, কিছু লাগবে না।'
আবরার মা'কে বলতে পারল না সে বউ আর মেয়েকে নিয়ে খেতে এসেছে। এসব খাবারে মা'র কোন আগ্রহ নেই, তবু কথাটা বলতে মুখে আটকালো। সবসময়ই এরকম হয়। তারা কোথাও বেড়াতে গেলে বা খেতে গেলে মা'কে বলা হয়ে ওঠে না। তার কেমন যেন মুখে বাধো বাধো ঠেকে। মনের কোণে অপরাধবোধের কাদা লেগে থাকে। যদিও সে জানে, মা'কে বললেই তাদের সাথে বেরিয়ে পড়বেন এমন মানুষ তিনি নন। সংসারের চার দেয়ালে থাকতেই ভালবাসেন তিনি। বাবা মারা যাবার পর থেকে নিজেকে আরো বেশি বন্দি করে নিয়েছেন। ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও না যাবার নানান বাহানা খুঁজতে থাকেন। সাথে না নিয়ে গেলেও মা'র জন্য খাবার পার্সেল করে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু নায়লা তাতে বিরক্ত হবে ভেবে সেটা করতে পারে না।
মা'র ফোন রেখে নায়লাকে কল দিতে জানা গেল ওরা ইতিমধ্যে ভেতরে বসে অপেক্ষা করছে। ওপরে উঠে একটু খুঁজতেই ওদের পেয়ে গেল আবরার। মা মেয়ে মুখোমুখি ছোট একটা টেবিল দখল করে বসেছে। আবরার এসে বসল মেয়ের পাশে। নাবা তাকে হাগ করে বলল, 'আই লাভ য়্যু বাবা।'
'লাভ য়্যু টুউ। কি খাবে, বলো? অর্ডার করা হয়েছে?' শেষের প্রশ্নটা নায়লার উদ্দেশ্যে।
'তোমার জন্য ওয়েট করছি। আমি পাস্তা খাব। নাবা বোধহয় শর্মাই খেতে চায়।'
'আমার বাবা কি খাবে?' আবরার মেয়ের দিকে ফিরল।
'শর্মা।'
'ওকে। আমিও শর্মা খাব।' সে ওয়েটার কে ডাকল।
তিনজনে গল্প করে খেতে খেতে দেড় ঘন্টা। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা। বিল মিটিয়ে ওঠার মুহুর্তে নাবা বলল, ' বাসায় গিয়ে কি আমরা ডিনার করব, বাবা?'
'তোমার যদি ইচ্ছে করে ডিনার করতে, তাহলে করবে।'
'হুম। তুমি?'
'আমিতো ঘুমাব আরো তিন ঘন্টা পর। ততক্ষণে হয়ত একটু কিছু খেতে ইচ্ছে করবে।'
ওরা মা মেয়ে কিছু খাক বা না খাক, আবরার জানে তাকে কিছু খেতেই হবে। তা নইলে মা'র কাছে ধরা পড়তে হবে। নায়লা ওসব কেয়ার করে না। একটা কিছু বলে দেয় মুখের ওপর। তাছাড়া মা খাবার আগলে বসে থাকে, কেউ না খেলে ব্যাপারটা খুব বিচ্ছিরি দেখায়।
ঢাকা শহরের জ্যাম বলে কথা। গাড়িতে চড়ে দশ পনের মিনিটে যে রাস্তা পাড়ি দেয়া যায়, সেটুকু পাড়ি দিতে ওদের আধঘণ্টার বেশি লাগল। গাড়ি এসে থামা মাত্র আবরার দেখল ফোন বাজছে। হাতে নিয়ে দেখল, তার ছোট বোনের নাম্বার।
'হ্যাঁ মুনিয়া, কি খবর?'
'তুমি কোথায় ভাইয়া? কতবার ফোন দিলাম?'
আবরারের মনে হল মুনিয়া কান্না চেপে রেখে কথা বলছে। সে খানিকটা বিচলিত হল।
'কেন রে? কোন সমস্যা নাকি? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? রিং তো শুনতে পাইনি, রাস্তায় জ্যাম, গাড়ির হর্ন। আমি আমাদের বাসার সামনে। এখনি ঢুকব।'
'আসো।' মুনিয়া লাইন কেটে দিল।
আসো মানে কি? মুনিয়া তো এ বাসায় থাকে না। ওর বাসা উত্তরা। জয়েন্ট ফ্যামিলি ওদের। আজ সকালেও তো মুনিয়া আসবে বলে শোনে নি। মা'র সংগে সন্ধ্যায় কথা হল, তখনো মা মুনিয়ার কথা কিছু বলেন নি। গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকলে আবরার চট করে নেমে পড়লো।
'তোমরা আসো আস্তে আস্তে। আমি যাচ্ছি। মনে হচ্ছে বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে।'
নায়লা একবার তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো, কিছু বলল না। আবরাররা পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে থাকে। লিফট এর তোয়াক্কা না করে সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে গেল। দরজার বেল বাজাতে হল না, হাত দিয়ে একটু ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু এ কি! পাশের বাসার লোকজন এখানে কেন? মুহূর্তেই মুনিয়াকে দেখতে পেল আবরার। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
'কতবার ফোন দিলাম তোমাকে, একটাবার যদি রিসিভ করতে! সব শেষ, ভাইয়া! সব!'
আবরার কেমন বিচলিত বোধ করতে থাকে। বুঝতে পারে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কি সমস্যা বুঝে উঠতে পারে না।
' কি হয়েছে? কি শেষ?' সে বোনের মাথায় হাত রাখে।
' মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে ভাইয়া। আর কোনদিন আসবে না!' মুনিয়া হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
আবরার টের পায় তার শরীরটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না। বোনের কথাগুলি তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিছুক্ষণ আগেই না সে তার মার সাথে কথা বলেছে! দরজার মুখে সে দাঁড়িয়েই থাকে, ভেতরে যাবার সাহসও হয় না। একসংগে অনেকগুলি প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে কিন্তু কোনটা রেখে কোন প্রশ্নটা করবে তাও সে বুঝতে পারে না।
'আসো, ভেতরে চলো।' মুনিয়া চোখ মুছে ভাইকে মা'র শোবার ঘরের দিকে নিতে চাইলো। কিন্তু আবরার বসার ঘরেই বসে পড়ল। আর কোথাও যাবার মত শক্তি এখন তার শরীরে নেই।
এসময় নাবা আর নায়লা ভেতরে ঢুকলো। তারাও পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন দেখে হতচকিত। পাশের ভদ্রমহিলা নিজেই এসে নায়লাকে খবরটা দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মা'র সাথে নাবাও গেল।
আবরার মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পাশে মুনিয়া।
'হঠাৎ মা বললো শরীর খারাপ লাগছে। বসে ছিল শুয়ে পড়লো। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে...। চারতলার যে মেয়েটা ডাক্তারি পড়ে, ও এসে দেখে গেল। বললো সব শেষ হয়ে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে কোন লাভ নেই। তবু আমরা চাইলে নিতে পারি। অন্যান্য মহিলারাও এসে একই কথা বললো।'
'তুই কখন এসেছিস?'
'বিকালে। আমার কেন জানি সকাল থেকে মনটা কেমন কেমন করছিল। মা'কে খুব মিস করছিলাম। তাই ঠিক করলাম দুপুরে খেয়ে এদিকে আসব। এসে তো দেখলাম সব ঠিকঠাক কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হল! তাও ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম, নইলে মা অমন একলা ঘরে.....।' মুনিয়া কথা শেষ করতে পারল না, আবার কান্নার দমকে তার কথা আটকে গেল।
আবরার কাঁদতে পারছেনা। পুরুষ মানুষ কারো সামনে কাঁদে না এরকম কিছু ভেবে নয়, তার কান্নাই আসছে না। সমস্ত অনুভূতি যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে। কোনটা থেকে কোনটা আলাদা করতে পারছে না সে। ছোটবেলায় কোনদিন মা'কে না বলে স্কুলে চলে গেলে পরে সারাদিন মনটা খুঁতখুঁত করতো, যেন কিছু জরুরি কাজ বাদ পড়ে গেছে, সব কাজের ফাঁকে বারবার মনে হত, কি যেন নেই কি যেন নেই! কোথায় যেন একটা বিরাট শূন্যতা। এই মুহূর্তে ঠিক সেরকমই শূন্য মনে হচ্ছে। এক লহমায় মাঝখানের এতগুলি বছর মিলিয়ে গিয়ে তাকে আবার সেই স্কুলের ছোট্ট ছেলেটি করে দিলো স্মৃতিরা। মনে হলো কিছুক্ষণ পরেই মা'র কাছে ফিরে যাওয়া যাবে, তখন আর এই দু:স্বপ্ন থাকবে না।
নায়লাকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য অনেক ছাড় দিয়েছে আবরার। এই ছাড়গুলোর একটা হলো নায়লা মাঝে মাঝে মা'র সংগে খারাপ ব্যবহার করা সত্ত্বেও ওকে শাসন করে নি সে। মা'কে না জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে এবং পরে বাচ্চাসহ বাইরে বাইরে মজা করে বেড়িয়েছে, হয়তো সংসারের বা মা'র একটা কাজ করে দেয়া হয় নি। বিশেষ করে বাবার অবর্তমানে যা তারই দায়িত্ব ছিল। বিয়ের পর মা'র সংগে বসে দু'দন্ড সময় কখনো কাটানো হয় নি অথচ মা মুনিয়ার চেয়ে যেন তাকেই বেশি ভালোবেসেছেন আজীবন। আজ মা'র মৃত্যুকালে মুনিয়ার মন কেমন কেমন করায় ও হুট করে মা'কে দেখতে চলে এসেছে, আর সে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে সুখের ভেলায় ভেসেছে। মুনিয়া বারবার তাকে ফোন করেছে মা'র চলে যাবার মুহূর্তে, সেই ফোনের রিং পর্যন্ত সে শুনতে পায় নি। নাহ, সে অন্যায় হয়তো কিছুই করে নি, কিন্তু মা'র সাথে তার আত্মিক বন্ধনটার অভাব ছিল, যা মুনিয়ার ছিল না!
মা'র জন্য কিছুই করতে পারে নি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব সুযোগ হেলায় হারিয়েছে এই বোধটা আবরারকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। এইসব কথা সে কখনো নায়লাকে বলবে না, মুনিয়াকেও না। নিজের মধ্যেই ভীষণভাবে দগ্ধ হতে থাকবে দিনের পর দিন, কে জানে হয়তো সারাজীবন। মা'র কাছে একবার ক্ষমা পর্যন্ত চাওয়ার কথা তার মাথায় আসে নি একটিবারের জন্য!
পরদিন সকাল দশটার মধ্যে মা'র দাফন শেষ হয়ে গেল। ছোটবেলায় মা'র মুখেই শুনেছে নানাভাইয়ের জন্য দুআ করছে, রাব্বির হামহুমা ক্বামা রাব্বাইয়ানি সাগীরা [হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন পালন করেছেন। (আল কুরআন, ১৭:২৬)]। এই দুআ সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই পড়তে থাকলো। মুনিয়া কয়েকদিন থাকবে, শ্বশুরবাড়িতে বলা আছে। এতে আবরার যে কি খুশি হয়েছে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। মা'র জায়গাটা কাউকে দিয়ে ভরবে না সে জানে, তবু বোনটা কাছে থাকলে যেন নিজের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়। সে নিজেও দু'দিন ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। বাবা মারা যাবার পর মা তাদের দুই ভাই বোনকে আগলে রেখেছিলেন, এমন করে বাবার অভাবটা টের পায় নি কখনো। কিন্তু মা যে এত আলাদা, সারাজীবন যা শুনে এসেছে, আজ হাড়ে হাড়ে সেটা বুঝতে পারছে।
আসর এর নামাজ এর পর ইমাম সাহেবের সাথে কথা হচ্ছিল মসজিদের বাইরে। মা'র খবরটা তিনি জানেন। তাছাড়া মাঝে মাঝেই আবরারের সাথে কথা বলেন তিনি, পাড়ার মধ্যেই থাকেন বলে জানাশোনা আছে। জুমআ'র নামাজ আবরার এই মসজিদেই পড়ে ফেলে। মসজিদের রেনোভেশানের কাজ শুরু হবে সামনের মাসে, তখন স্বল্প পরিসরে জামায়াত হবে, ইমাম সাহেব বলছিলেন।
'বুঝলে আবরার, এই ক'টা দিন হয়তো জামায়াতে মুসল্লি খুব একটা হবে না। তাও চালিয়ে তো যেতেই হবে।'
'তা তো বটেই।'
'আর অনেক টাকার দরকার। আজকাল ইট, বালু, সিমেন্টের যা দাম বোঝই তো। মসজিদের ফান্ডে এত টাকা নেই। কিছু ডোনেশান অবশ্য পেয়েছি, তবে আরো অনেক দরকার। আর তাছাড়া সবার টাকা নেয়াও যায় না! কার কতটা সৎ উপার্জন নিশ্চিত করে তো বলা যায় না।'
আবরারের মনে হলো, আল্লাহ্ তাকে একটা পথ দেখাচ্ছেন, যার উৎস সে গতকাল থেকে মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
'আমি কিছু টাকা এই কাজের জন্য সাদাক্বা করতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?'
ইমাম সাহেব খুশি হয়ে হাসলেন, 'এটা তো সুখবর যে তুমি সাদাক্বা করতে চাও। তোমার সততা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আপত্তি থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।'
'এই টাকাটা আমি আমার মা'র জন্য দিতে চাই। মা'র জন্য সারাজীবন কিছুই করতে পারি নি!'
'ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি কবুল করে নিন।'
'আমি কাল পরশুর মধ্যে আপনাকে চেক দিয়ে যাব। ফান্ডের দায়িত্বে যারা আছে, তাদের মধ্যে আপনিও তো একজন।'
'হ্যাঁ। ঠিক আছে, তোমার যেমন ইচ্ছে।'
আবরার ইমাম সাহবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলো। তার দু'চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। সামনের পথটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। কিন্তু তার মনের ভারটা অনেক কমে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন