সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮

ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, পরকালীন ভাবনার উদয়

ছাইদুর রহমান

পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যার লালিমা আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশের বুকে মাথা তুলেছে অগণিত তারকা। শুয়ে শুয়ে পড়তে বিরক্তিকর লাগছিল, তাই পড়ার টেবিলে বসেছি। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, গরমের দিনে এই এক সমস্যা। বারবার ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। আর মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। মোমের আলোতেই পড়ার কাজ চালিয়ে নিচ্ছি আপাতত, মোমের নরম আলো চোখে আরাম দেয়, তন্দ্রালু একটা ভাব চলে আসে। টেবিলের পাশেই দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা, হুহু করে প্রবেশ করছে আম্র-মুকুলের সুবাস মিশ্রিত ফুরফুরে বাতাস, শরীর-মন বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে সে বাতাসে।

     
ঝিঁঝিঁপোকারা যেন ডাকের প্রতিযোগিতায় নেমেছে, পাতার ফাঁক-ফোকরে বসে মনের আনন্দে ডেকে যাচ্ছে তারা, একঘেয়ে সুরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। আচ্ছা, এদের নাম 'ঝিঁঝিঁ' হয়েছে কেন? ঝিকঝিক করে ডাকে বলে?   হলেও হতে পারে। এই ঝিঁঝিঁগুলো আমার কাছে এক বিস্ময়। সারাবৎসর এদের কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না, শুধুমাত্র বসন্তের সময়টাতে বের হয়ে আসে। ডাকতে ডাকতে নিজেকে শেষ করে দেয়। বসন্ত শেষে গাছের বাকল কিংবা পাতায় এদের কঙ্কালগুলোর দেখা মেলে। প্রকৃতির আলো-বাতাস গ্রহণ করে বসন্তের জন্য  নিজেদের উৎসর্গ করে দিতে বড় হয়ে ওঠে ঝিঁঝিঁরা।
কোথা থেকে যেন একটা ঝিঁঝিঁপোকা দলছুট হয়ে আচমকা আমার টেবিলের উপর এসে পড়ল; হয়তো কোন পাখির তাড়া খেয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এসেছে, কিংবা মোম-সালিতার মধ্যমনি এক টুকরো অগ্নিশিখা তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে এনেছে। সে জানেনা,  এই হাতছানিটা তার জন্য কতটুকু বিপদজনক! যদি জানতো, তাহলে এই ধ্বংসাত্বক হাতছানিতে কিছুতেই সাড়া দিত না; নিজের কাফেলায় অবস্থান করে নিরাপদে গেয়ে চলতো বসন্তগীত।
   
কিন্তু দুর্ভাগা পোকাটা নিজের কুপ্রবৃত্তির কাছে মাথা নত করে দিয়েছে। মিথ্যে মরীচিকার মোহে পড়ে ছুটে এসেছে একটুকরো জাহান্নামের দিকে; যে জাহান্নাম তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবে, তার পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ ছাই আকারে মোমের তপ্ত-তরলে বিলীন হয়ে যাবে, তার সাথীরা ঘুণাক্ষরেও জানবে না যে, তাদেরই একজন মিথ্যে মোহের জালে আটকে নিজেকে ক্ষয় করে দিয়েছে। পোকাটির অবস্থা এখন মরুভূমিতে মিথ্যে মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা দুর্ভাগা মুসাফিরের ন্যায়, যার সামনে মৃত্যু নামক ভয়ঙ্কর এক দানব হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
          
ঝিঁঝিঁর সাথে নিজেকে তুলনা করতে গিয়ে মনের অজান্তেই আঁৎকে ওঠলাম!  অামাদের অবস্থাতো এই ঝিঁঝির চেয়েও ভয়াবহ হবে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক অগ্নিশিখা, যাকে তাপের পর তাপ দিয়ে কালো করা হয়েছে, যে জাহান্নামের শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মানুষ আল্লাহ তায়ালার কাছে মৃত্যুর জন্য হাহাকার করবে, কিন্তু তাদেরকে মৃত্যু দেয়া হবে না।  শরীরের  লোমকূপে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। এ কোন মায়ার জগতে পড়ে আছি আমরা! মৃত্যুর নির্মম শিকারে পরিণত হওয়ার পূর্বে আমাদের মরণ-ঘুম কি ভাঙবে না? পরকালকে ভুলে গিয়ে দুনিয়া নামক মিথ্যে মরীচিকার পেছনে আর কতোদিন ছুটব?
  
মসজিদের মিনার থেকে অাযানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে এলো -আল্লাহু অাকবার.. আল্লাহু আকবার... ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তে। প্রকৃতির কোলাহল যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, ঝিঁঝিরাও যেন কিছুক্ষণের জন্য ডাকতে ভুলে গেল। সবাই উৎকর্ণ হয়ে, কান পেতে শুনছে মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা। টেবিল-চেয়ার ছেড়ে ঝটপট উঠে পড়লাম নামাজ পড়ার জন্য। মহান প্রভুর পদতলে এই তুচ্ছ দাস নিজেকে লুটিয়ে দেয়ার চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...