মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৭

সুসং দুর্গাপুর

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়,
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
অপার সৌন্দর্যের এ বাংলাদেশকে প্রকৃতি
তার সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে। যাঁরা
মনে করছেন এখনো বাংলাদেশের অনেক
জায়গা আপনার দেখা হয়নি তাঁরা খুব
সহজেই নেত্রকোনা জেলার সর্বউত্তরে
ভারতের গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
দাঁড়ানো ছোট্ট জনপদ সুসং দুর্গাপুর দেখে
আসতে পারেন।
সোমেশ্বর পাঠককে যুদ্ধে পরাস্ত করে
সুসঙ্গ অর্থাৎ ভালো সঙ্গ নামে এক
সামন্ততান্ত্রিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই
সোমেশ্বর পাঠকই সুসঙ্গ রাজবংশের আদি পুরুষ। এর পরই দুর্গাপুরের নাম হয় সুসং দুর্গাপুর। তো দেরি কেন? ঘুরে আসুন

 সুসং দুর্গাপুরের দর্শনীয় স্থানগুলো:
সুসং দুর্গাপুর নেত্রকোনা জেলার উত্তর
প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশের এক
জনপদের নাম। সেখানে বয়ে গেছে টলমলে
জলের সোমেশ্বরী আর দিগন্ত হারিয়েছে
আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড়ে। ছোট্ট একটি
জায়গা যার পরতে পরতে জড়ানো সৌন্দর্য।
এখানে দেখার মতো আছে গারো পাহাড়,
সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি, ক্ষুদ্র নৃ-
গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, টংক
আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি, হাজং মাতা রাশিমণির
স্মৃতিসৌধ, সাদা মাটির পাহাড়।

গারো পাহাড়:
সুসং দুর্গাপুরের উত্তর সিমান্তে
নলুয়াপাড়া, ফারংপাড়া, বাড়মাড়ি,
ডাহাপাড়া, ভবানিপুর, বিজয়পুর ও
রানিখংসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এর
বিস্তার। এই পাহাড়ে প্রচুর পরিমাণে
মূল্যবান শালগাছ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া
যায়। এই পাহাড়গুলো প্রাকৃতিক মনোরম
সৌন্দর্যের আঁধার। প্রকৃতি তার ঝুলি উজার
করে দিয়েছে এ গারো পাহাড়কে
সাজাতে। বিচিত্র স্বাদের প্রকৃতির
অলংকার যেন মানায় এই ভুস্বর্গকেই।
পাহাড়-পর্বত, ছোট-ছোট নদী, পাহাড়ি
ঝরণা, শাল-গজারিসহ নানা প্রজাতির
গাছ, সৌন্দর্য মেশা উঁচু-নিচু পথ দিয়ে ঘুরে
ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। সবুজের অপার
সমারোহ এই গারো পাহাড়। পাহাড়ের
অসমতল উঁচু-নিচু টিলার মধ্য দিয়ে বয়ে
গেছে ঝরনা। যার স্বচ্ছ জলরাশিতে নিজের
প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। দুই
পাহাড়ের মাঝে সমতল ভূমি। সমতল ভূমিতে
সবুজ শস্যক্ষেত। পাহাড়ে পায়ে চলার
দুর্গমপথে চলাচল করে পাহাড়ি মানুষ।
কোথাও কোথাও টিলার ওপর দেখা যাবে
ছোটছোট কুঁড়েঘর। সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে
নীল আকাশ। অপার সৌন্দর্যের এ পাহাড়
চোখ জুড়িয়ে দেয় যেকোনো পর্যটকেরই। এ
এলাকায় বাস করে বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষুদ্র
নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন। তার মধ্যে গারো,
হাজং, কোচ, মুরং উল্লেখযোগ্য।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি
দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ডের পাশেই অবস্থিত
ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এ
অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর
নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে।

সুসং দুর্গাপুর ও এর আশপাশের উপজেলা:
কলমাকান্দা, পুর্বধলা, হালুয়াঘাট এবং
ধোবাউড়ায় রয়েছে গারো, হাজং, কোচ,
ডালু, বানাই প্রভৃতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর
বসবাস।
এদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য ১৯৭৭
সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
কালচারাল একাডেমি।

চীনামটির পাহাড় বা সাদমাটির পাহাড়:
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭
কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কুল্লাগড়া
ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া
মৌজায় বিজয়পুরের শসার পাড় ও
বহেরাতলী গ্রামে সাদামাটি অবস্থিত।
এখান থেকে চীনামাটি সংগ্রহের ফলে
পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট
পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের
গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধারগুলো
দেখতে অত্যন্ত চমৎকার। এই অঞ্চলের
আনুমানিক ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন
সাদামাটি বাংলাদেশের ৩০০ বছরের
চাহিদা পূরণ করতে পারে। বিভিন্ন রঙের
মাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম
সৌন্দর্য মনকে বিমোহিত করে। সাদা,
গোলাপি, হলুদ, বেগুনি, খয়েরি, নীলাভসহ
বিভিন্ন রঙের মাটির পাহাড় চোখকে
জুড়িয়ে দেয়।

সোমেশ্বরী নদী:
সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ পানি আর ধুধু
বালুচরের জন্য বিখ্যাত। এটি নেত্রকোনা
জেলায় প্রবাহিত একটি নদী। মেঘালয়
রাজ্যের বাগমারা বাজার হয়ে
বাংলাদেশের রানীখং পাহাড়ের পাশ
দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ
করেছে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোনো
মৌসুমে সোমেশ্বরীতে পানি প্রবাহ
থাকে না। এই নদীর পানিতে নেমে পায়ে
বালির স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতিটা দারুণ।
চাইলে মাঝিকে ১০ টাকা দিয়ে নদীর
এপার ওপার ঘুরে আসতে পারেন। আর শহুরে
এলাকায় যাদের একেবারেই ইট পাথরের চার
দেয়ালে বড় হওয়া তাদের ভেতরের
মানুষটিকে রঙিন করে তুলতে পারে এ নদীর
সরল কিন্তু তীব্র সৌন্দর্য। আর এসব কিছুই
দেখা যাবে দুর্গাপুরে।

কীভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে সুসং দুর্গাপুরে যাওয়ার এবং
ফেরার জন্য সবচাইতে ভালো হবে ঢাকার
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সুসং
দুর্গাপুরের দিনে ও সন্ধ্যায় বেশ কিছু বাস
ছেড়ে যায়। এবং এই বাসের ভাড়া পড়বে
৩০০ টাকা।
মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশা
বা রিকশা নিয়ে শম্ভুগজ্ঞ মোড়ে গিয়ে
ব্রিজ এর সামনে থেকে দুর্গাপুর বাসে উঠে
পড়লে পরের আড়াই / তিন ঘণ্টা বাসে বসে
ঝাঁকি খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই
।এর পর সুসং দুর্গাপুরে পৌঁছালে নেমে
রিকশায় গেস্ট হাউসে । রাস্তা শ্যামগজ্ঞ
পর্যন্ত খুবই ভালো, সুন্দর এবং আরামদায়ক।
শ্যামগজ্ঞ থেকে ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা
কার্পেটিং ছাড়া । যদিও খানাকন্দ নাই
খুবই ভারি ভারি বালু এবং কয়লার ট্রাক
চলাচল করে বলে রাস্তা টেকে না কিন্তু
সবসময় ভেজা এবং সমান থাকে। বাসের
ভাড়া ৮০ টাকা । বাস থেকে সিএনজি
ভ্রমণ আরামদায়ক। সময় লাগে মাত্র দেড়
ঘণ্টা, ভাড়া ১৫০ টাকা জন প্রতি । এক
সিএনজিতে পাঁচজন আসা যায়।
সুসং দুর্গাপুর বাজার থেকে রিক্সা বা
মোটরসাইকেল নিয়ে সুনীল সোমেশ্বরী
নদীপার হয়ে গারো পাহাড়, গোলাপি
পাহাড়, নীল/সবুজ পানির লেক ঘুরে আসা
যায়। সেখানে ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার
ছাড়াও দেখার মতো রয়েছে একটা চার্চ ও
মুক্তিযুদ্ধকালীন ট্রেনিং নেওয়ার জন্য
কয়েকটি পিলার। সারাদিনের জন্য রিকশা
অথবা মোটরসাইকেল ভাড়া করে ঘুরে
আসতে পারেন পুরো দুর্গাপুর যেখানে
আপনাকে খরচ করতে হবে ৪০০-৮০০টাকা
(যার কাছে যা রাখতে পারে)।
থাকা-খাওয়া ও বাড়িফেরা
এখানে বিভিন্ন মানের গেস্ট হাউস আছে।
জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
কালচারাল একাডেমি গেস্টহাউজ, ইয়ুম
মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন রেস্ট
হাউজ রয়েছে। যেখানে রুম ভাড়া পড়বে ৭৫০
টাকা। এ ছাড়া এখানে কিছু মধ্যমমানের
হোটেল আছে। স্বর্ণাগেস্ট হাউজ, হোটেল
সুসং, হোটেল গুলশান, হোটেল জবা, নদী-
বাংলা গেস্ট হাউসে ১৫০-৪০০ টাকার মধ্যে
থাকা যায়। এখানে হয়তো পাওয়া যাবে না
ফাইভস্টারের খাবার কিন্তু এত
আতিথেয়তায় চ্যাপা শুঁটকি থেকে শুরু করে
মাছভর্তা সবকিছুতেই পাওয়া যায় ঘরোয়া
রান্নার স্বাদ।
সারিবদ্ধ সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ পানির
পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী, দিগন্ত বিস্তৃত
বালুচর যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। তাই মুগ্ধতা
পেতে আর দেরি না করে একবার হলেও ঘুরে
আসুন সুসং দুর্গাপুরে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...