ইলা ইসরাত
প্রিয় বাবুই সোনা,
কেমন আছিস মা? আমাকে ছাড়া, তোর বাবাকে ছাড়া থাকতে তোর কষ্ট হয় না? মনে হয় এখন আর তোর কষ্ট হয় না আমারও কম হয়।বিশেষ এই দিনটিতেই তোকে খুব করে মনে পড়ে। তারপর তোর বয়সী কাউকে দেখলেই বুকের ভেতরটা কেঁদে উঠে। তখন আয়াতকে বুকে চেপে তোকে হারানোর কষ্টটা ভুলতে চেষ্টা করি। আয়াতের ছোট্ট ছোট্ট হাতের স্পর্শ যখন আমার চোখের জল মুছে দেয়, তখন প্রকৃতপক্ষেই তোকে হারানোর কষ্টটা একটু হলেও ভুলে যাই। ভুলে না শুধু তোর বাবা। নিজেকে আজও অপরাধী ভেবে সবার আড়ালে চোখের জল ফেলে তোর বাবা। আমি আর আয়াত ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর জন্য বানানো কাঁথা, তোর জন্য কিনে আনা খেলনাগুলি, ছোট্ট নুপুর, বালাগুলি বুকের মাঝে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে। জানিস! বাবুই সোনা, তোর জন্য কিনে রাখা একটা জিনিসও নষ্ট হতে দেয়নি তোর বাবা। বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। এমনকি আয়াত যখন আমাদের মাঝে আসে, তখনো তোর জন্য আনা জিনিসগুলোতে তোর বাবা কাউকে হাত দিতে দেয়নি। আয়াতের জন্য নতুন করে সব কিনে এনেছে।
তুই পৃথিবীতে আসার আগেই তোর বাবা তোর জন্য সব কিনে রেখেছিল। কিন্তু তুই কেনো জানি অভিমান করে আমাদের একা রেখে চলে গেলি। সেই থেকে তোর বাবা ভয় পেয়ে গেছে। তোর বুঝি তোর বাবার কেনা খেলনা, নুপুর,বালাগুলি পছন্দ হয়নি, তাই তুই অভিমান করে চলে গেলি। তাই তোর বাবা আয়াত পৃথিবীতে আসার পর ওর জন্য জিনিস কিনে।
বাবুই সোনা আজ তোর ৫ বছর হলো। আবার আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ারও ৫ বছর হলো। তুই চলে যাওয়ার পর থেকে এই দিনটাতে তোর বাবা আর আমি দুজনে মিলে চেষ্টা করি পথের কিছু শিশুকে ভাল কিছু খাওয়ানোর। জানি তুই রাগ করিস, কেক কেনো কাটি না সেজন্য। কী করে কাটবো বলতো মা? এই দিনটাই যে তোর মৃত্যুর দিন। তাই আর কেক কাটতে পারি না।
যেদিন আমার ভিতর তোর অস্তিত্ব টের পেলাম, সেদিন আনন্দে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আমিও কারো মা হতে যাচ্ছি, আমার ভিতরে একটু একটু করে কেউ বড় হবে। এগুলো ভাবতে ভাবতেই আমার দিন চলে যেতো। আর রাত কাটতো তোর জন্য তোর বাবার পাগলামি দেখে। রোজ রাতেই অফিস থেকে আসার সময় তোর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। আমি সেগুলো দেখে হাসতাম। যখন জানতে পেলো তুই আমাদের পরী হবি, ঐ দিনই তোর বাবা তোর জন্য নুপুর নিয়ে এসেছিলো। আর বালাগুলি এনেছিলো তুই পৃথিবীতে আসার কিছুদিন আগে।
তুই যেদিন আমাদের পৃথিবী আলো করে আসতে চেয়েছিলি সেদিন বাসায় কেউ ছিলো না। ওয়াশরুমে স্লিপ কেটে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফিরে, তখনও জানতে পারিনি তুই আর আমাদের মাঝে নেই। তোর বাবাকে তোর কথা জানতে চাইলেই বলতো, তুই ভাল আছিস। আমি একটু সুস্থ হলেই তোকে আমার কাছে এনে দিবে। কিন্তু তোর বাবা তোকে আর আমার কাছে এনে দিতে পারেনি। তোকে তো আমি দেখিনি তোর বাবা তোকে দেখেছিলো। তাই সারাক্ষণ পাগলের মত জিজ্ঞাসা করতাম, তোর নাকটা কি বোচা হয়েছিল, চোখ দুটো কি আমার চোখের মত হয়েছিলো, মাথায় চুল কেমন ছিলো তোর, তুই কার মত হয়েছিলি? আমার মত নাকি তোর বাবার মত? নাকি আমাদের দুজনকে মিলিয়েই হয়েছিলি?
বাবুই সোনা! আমাদের ছেড়ে কেনো চলে গেলি? কেনো মাতৃত্বের ছোঁয়া জাগিয়ে আমায় 'মা' না বলেই চলে গেলি। জানিস! বাবুই সোনা, মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলায় তুই আকাশী রঙের একটা জামা পরে আমায় মা বলে ডাকছিস। আমি তোকে দেখে বলি- কী সুন্দর লাগছে আমার পরীটাকে। বলতে বলতেই তোকে আর আমি খুঁজে পাই নারে মা।
যেখানে থাকিস ভাল থাকিস মা।
ইতি
তোর মা
তোর মা

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন