সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

নেশা

লাইজুর ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। কন্টাক্টরের ডাকে হুশ হয়। বাস 'সাইনবোর্ড' এসে গেছে। ঝটপট বাস থেকে নেমে পা চালায়।
" এই ভুইগড়, ঝালকুড়ি, চাষাড়া... আগে যাইব...আসেন আসেন.." টেম্পুগুলি ডাকছে।
লাইজু এগিয়ে একটাতে চড়ে। এই অল্প একটু রাস্তা হেঁটে হাঁপিয়ে যায়। আজ ও একা। প্রতিবার ওর সাথে মালতী থাকে। এই প্রথম নারায়ণগঞ্জ একা যাচ্ছে ও।

মালতীর খুব জ্বর। বলল, "তুই যা, ভয়ের কিচ্ছু নাই। সব কয়া দেওয়া আছে। যাবি, জিনিষটা দিবি, চাষাড়া মোড়ে একপ্লেট কাচ্চি খাবি আর চইলা আসবি।"
লাইজু আগে গার্মেন্টসে কাজ করত। ওর এই লাইনে হাতেখড়ি মালতীর মাধ্যমে।
মালতী সময় পেলেই ওকে শেখায় কী করতে হবে, কী বলতে হবে।
"শোন, সবসময় সাইজাগুইজা যাইতে হইব। দেকলে মনে কইব বেড়াইত যাই।..
"কেউ জিগাইলে কইবি গার্মেন্টস এ কাম করি।
"চেক করলে সব দিয়া দিবি। তুই দেরি করলেই কইলাম সন্দেহ করব।
"গাড়িত থন নাইমা ইতিউতি তাকাইবি না।
"যেইহানে যাওয়ার কাম সোজা চইলা যাবি।
"কাস্টমার তর কাছে আগে কিন্তু আইব না। তুই আগে বাইরা কইবি 'ফারিয়া কোন দিক?' এইডাই হইল সিগনাল। বুঝছস?" ইত্যাদি ইত্যাদি।
লাইজু এ পর্যন্ত দশ-বারোবার মালতীর সাথে মাল ডেলিভারি দিছে। সহজ কাজ। মাল ডেলিভারি দাও, টাকা বিকাশে পাও। একবার পিছনে ফেউ লাগায় ফেরত আসছে, নয়ত আর কোনবার সমস্যা হয় নাই। মালতী বলছে জায়গা মত টাকা দেয়া আছে, কোন 'পবলেম' নাই।
'কতদ্রুত যে সময় চইলা যায়' লাইজু ভাবে। আজকের কাজটা হলে ও দুইহাজার টাকা পাবে। এই কাজে রিস্ক যেমন বেশি, ইনকামও বেশি। ও একজোড়া সোনার দুল বানাইতে দিয়েছে।  টাকাটা পেলে নিয়ে আসবে। 
লোক ভরে যাওয়ায় টেম্পুটা ছেড়ে দেয়। ওই একমাত্র মহিলা যাত্রী। ঝালকুড়ি স্টপেজে আসার পর কয়জন লোক নেমে যায়। কয়জন উঠে।
সামনে পুলিশ চেকপোস্ট। লাইজু ওইদিকে তাকায় না। ভয় আর টেনশনে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আগে এমনও হয়েছে চেকপোস্টে টেম্পু থামায় নাই। কখনো আবার থামাইছে। মালতী সাথে থাকলে নির্ভয়ে চুপচাপ বসে থাকত। কখনো আবার অনর্থক ওর সাথে কথা বলছে, যেন কতদিনপর বান্ধবীর সাথে দেখা।
পুলিশের সিগনাল পেয়ে টেম্পুটা ব্রেক করে। দুজন পুলিশ এসে ভেতরে তাকায়।
"এই যে আপনে আর আপনে নামেন..তাড়াতাড়ি। " হাক দেয়।
যে লোক দুজনকে নামতে বলা হইছে ওরা নার্ভাস হয়। ধীরে সুস্থে নামে। বাকিরা হাফ ছাড়ে।
লোক দুজনকে চেক করতে করতে পুলিশ দুজন নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। মিনিট পাচেক পর জিজ্ঞাসাবাদ আর চেক করা শেষে ওরা ছাড়া পায়। লোক দুজন টেম্পুতে যখন উঠছে, একজন পুলিশ টেম্পুর হেলপারকে দাঁড়াতে বলে।
"কন্সটেবল রেহানা পারভীন..।"
একজন মহিলা পুলিশ পাশের ক্যাম্প থেকে বের হয়ে টেম্পুর দিকে এগিয়ে আসে। এসেই লাইজুর দিকে তাকিয়ে বলে, "বাড়ি কই?"
লাইজু এর জন্য প্রস্তুত ছিলনা মোটেই। ও তোতলায়, "...ম-ম-ময়মনসিং.."
"একা?.. কই যাও?..সাথে কে আছে?..নিচে নাম।" এক সাথে তিনটা প্রশ্নের উত্তর দিতে ও ঘেমে নেয়ে ওঠে।
পাশের ক্যাম্পটা, একটা দুইরুমের ছোট দালান। ভিতরে আরেকজন মহিলা পুলিশ বসা ছিল। লাইজু ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে ওকে চেক করা শুরু করে। একজন ওর হাত থেকে ব্যাগটা নেয়। লাইজু জানে ওরা কিছুই পাবে না কিন্তু তবুও ওর ভয় কাটে না।
"নাম?"
"নাজমা।"
"বাড়ি?"
"ময়মনসিং।"
"কি কর?"
"গার্মেন্টসে কাম করি"
"বাবার নাম?"
"করিম আলী"
"কই যাও?"
"নারায়ণগঞ্জ, ফারিয়া গারমেন্স"
কতক্ষণ যাবৎ চেকিং হলো ও বলতে পারবে না। চেক করা শেষে ওকে ওরা যেতে বলে। লাইজু ওর ব্যাগটা হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসে।
পুলিশের একজন লোক ওয়ারলেস হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। লাইজু বের হয়ে সোজা টেম্পুর দিকে এগুতেই,
"এই মেয়ে দাড়াও।"
লাইজু দাঁড়িয়ে পড়ে।
"তোমার বাড়ি কোথায়?"
"সোনারগাঁও.." বলেই বুঝতে পারে ও ভুল করে ফেলেছে।
পুলিশ লোকটা হাতের ইশারায় টেম্পুটাকে চলে যেতে বলে। লাইজু ভেজা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ওটার চলে যাওয়া দেখে।
nazibulalam@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...