শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

দ্বিধা

শীতের সকাল।
ক্যাম্পাসে এসে বসে আছি রিমা চত্ত্বরে। শীতের মধ্যে সচরাচর বের না হলেও আজকে বাধ্য হয়েছি একজনের কারণে। আশেপাশের সব বেঞ্চগুলো কাপল দ্বারা পূর্ণ হয়ে আছে। শীতের সকালে তারা একে অপরের মাঝে উষ্ণতার বিনিময় ঘটাতেই ব্যস্ত! ভাগ্যক্রমে এই বেঞ্চটা আমি ফাঁকা পেয়ে বসেছি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর ভাবছি এতদিন পর আহির হঠাৎ আমাকে স্মরণ করলো কেন! আমাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে নিজেই এখন নেই! আমার কাছে পৃথিবীর সবথেকে বিরক্তিকর কাজ হচ্ছে কারো অপেক্ষায় বসে থাকা। তাই বিরক্তি এসে যাচ্ছে খুব। কেন যে এখনো আসছেনা মেয়েটা, এতক্ষণে তো ওর এসে পড়ার কথা!

.
উদ্ভ্রান্তের মতো এদিকওদিক তাকাচ্ছি এমন সময় কাঁধে একটা শীতল স্পর্শ পেয়ে ফিরে দেখি আহির দাঁড়িয়ে। এই শীতের মধ্যে এতক্ষণ একাকী বসিয়ে রাখার দরুণ মেয়েটাকে আমার অনেক ঝাড়ি মারা উচিত, কিন্তু কেন জানি আমি তা পারছিনা! আমার সমস্ত চিন্তা-চেতনা যেন ঐ মুখের মধ্যেই নিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে ক্লান্ত- বিধ্বস্ত এক নারীমূর্তি যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
.
আহিরকে এই চেহারায় দেখে আর "কেমন আছো" বলার প্রবৃত্তি হয়নি আমার। সেও একবারের জন্য জিজ্ঞেস করেনি আমি কেমন আছি! হয়ত ভেবেছে আমি ভালোই আছি, অথবা ওর খেয়ালই নেই সেটা। বসার জন্য জায়গা করে দিলে আহির আমার পাশেই বসে। অনেকদিন পর আজকে দেখা হওয়াতে দুজনের মধ্যে কিছুটা জড়তা কাজ করছে। কেউই ঠিকমতো কথা বলতে পারছিনা। একটু পরে ও ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
সময় পেলে আসিও বিয়ের দিন।"
.
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুই বলতে পারছিনা ওকে। তারপরও নিজেকে সামলে খুশিখুশি চেহারা নিয়ে লম্বা একটা অভিনন্দন জানাই আহিরকে। কিন্তু কেন যেন খুশিটা ঠিক মানাচ্ছে না মুখে। আহিরও বলে ফেললো তা দেখে- "এত খুশিখুশি ভাব দেখাইতে হবেনা আমাকে, তোমার মুখে ওটা ঠিক আসছেনা।"
ওর কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার জোগাড়।
ক'দিন পরে আমাদের দুজনেরই অনার্স শেষ হবে, কিন্তু তার আগেই বিয়ে। মেয়েটা বিয়ে করতে চায়নি এত তাড়াতাড়ি, তবুও বাসা থেকে জোর করে দিচ্ছে। একারণেই বুঝি ওর মন এতটা খারাপ।
"বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে তবে?"- আমি প্রশ্নটা করতেই আহির একটা তীর্যক চাহনি দিলো, যার মানেটা এমন দাঁড়ায় যে মৃত্যুদণ্ড পাবার মতো অপরাধ করা আর ওকে এই প্রশ্ন করা সমান! আমি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিই অন্যদিকে।
.
মেয়েটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই। সেদিন দুপুরের দিকে দোকানে যাই প্রাক্টিকাল খাতার কভার করতে। খাতাটা দোকানদার ভাইকে কভার করতে দিয়ে আমি অন্যকাজে যাই। ফিরে এসে তাড়াহুড়া করে খাতা নিতে গিয়ে আরেকজন এর খাতা নিয়ে চলে আসি। আধাঘণ্টা পরে সেটা বুঝতে পেরে যখন আবার দোকানে এসে দাঁড়াই, তখন দেখি এক অপ্সরী প্রচণ্ড রকমের রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মেয়েটার চোখেমুখে রাগের পাশাপাশি একটা অসহায়ত্বের ছাপও ফুটে উঠেছে। হয়ত কষ্টকরে লেখা খাতাটা হারিয়ে গেছে এই ভয়ে। ফর্সা চেহারাখানা রাগে লাল হয়ে গেছে। নাকটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেয়েটার। ভয়ে মিনমিন করে খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলি, "দেখেন তো এইটা হয় কিনা।" দেয়ার পরে কিছুকাল আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। অনেক কষ্টে তাহার রাগটা কমিয়ে পরিচিত হতে গিয়ে জানি, দুজনেই একই ব্যাচের কিন্তু ডিপার্টমেন্ট আলাদা। মেয়েটার নামটা আমার কাছে খুবই ভাল লাগছে।
আহির।
নামটার মধ্যেই যেন একটা সুন্দর সুন্দর ভাব আছে। রাতেরবেলা বহুত খোঁজাখুঁজি করে এফবি আইডি বের করে রিকুয়েস্ট দিই আর ছোট্ট করে একটা ম্যাসেজ পাঠাই, "আমি আকাশ। আপনার খাতাচোর!"
.
রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট হয়, বন্ধুত্বটাও শুরু হয়। কিছুদিন পরে তার জন্মদিনে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা করি। মেয়েটা অনেক খুশী হয়। অল্পস্বল্প দেখা করে আড্ডা দেয়া আর মেসেজিং এর মাধ্যমেই দিন চলে যায়। কিন্তু কোনো এক কারণে আমাদের মধ্যে "তুমি" করেই সম্বোধন চলতে থাকে। আমি তাকে তুই করে বলতে পারিনি। ছমাস না যেতেই আমি বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছেনা! আহিরকে আমি আর বন্ধু ভাবতে পারছিনা। এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারি যে, আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আহির বলতো সে কখনো প্রেম করবেনা। পড়ালেখা শেষ করে জব নিয়ে তবেই বিয়ে করবে। ধীরেধীরে আমি আহিরের উপর প্রচণ্ড রকমের দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা আমি আহিরকে কখনই বুঝতে দেইনি, তবুও মনে হয় আহির আমার দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে। কারণ মেয়েদের নাকি তৃতীয় চোখ থাকে, যেটা দিয়ে তারা দেখতে পারে কে তাকে ফলো করছে!
.
আমার বন্ধুসংখ্যা খুব কম থাকাতে সবসময় চাইছি আহির আর আমার বন্ধুত্বটা যেন সচল থাকে। আমার কোনো ত্রুটির কারণে বন্ধুত্বটা যেন নষ্ট না হয়। শেষমেশ দুর্বলতাটা কাটাতে না পেরে আহিরের সাথে আমি দূরত্ব বাড়িয়ে দেই। দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দেই, কথা বলাটাও অনেক কমিয়ে দেই। কিন্তু আহির আমাকে নিয়ে কী ভেবেছে, তা আজও বুঝতে পারিনি এবং এই একবছরে বুঝার চেষ্টাও করিনি। আজ প্রায় তিনমাস পরে আহিরের সাথে আমার দেখা, সামনাসামনি ওকে দেখে কেমন যেন একটা জড়তা চলে এসেছে ভেতরে।
.
হঠাৎ একটা ধাক্কা এসে আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটায় ও আমি নিজেকে মাটিতে আবিষ্কার করি। আর মহারাণী তা দেখে হাসছেন! ইচ্ছা করছে মাথাটা ফাটিয়ে দেই বদমেজাজি মেয়েটার কিন্তু সে সাহস আমার নেই।
আহির নিজেই আমাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে, "আমি অনেক আগেই বুঝতে পারছি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি বলতাম প্রেম করবোনা, তাই হয়ত তুমি কখনো মুখ ফুটে বলোনি আমায়! আমিও তোমাকে তোমার মতো ভাবতে দিয়েছি, চলতে দিয়েছি। তুমি যতটা দূরত্ব চেয়েছো ঠিক ততটাই দিয়েছি। "এগুবো নাকি এড়িয়ে যাবো"- এই দ্বিধাতেই দিন কেটে গেছে আমার। আমি দেখতে চেয়েছি এর শেষটা কেমন দাঁড়ায়। অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি আমাকে ভালোবেসে তুমি খুব একটা দোষ করোনি।
আর এখন এইভাবে হাবার মতো না তাকিয়ে কার্ডটা খুলে দেখো যেতে পারবে কিনা বিয়ের দিন।"
মোহাবিষ্ট হয়ে কথাগুলো শোনার পরে খাম খুলে দেখি একটা গ্রেটিং কার্ড এ লিখা -
"বিয়ের তারিখটা কবে হবে মি. খাতাচোর?"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...