(১)
- 'কিরে, একা বসে ঝিমুনি হচ্ছে, না? আগামী কাল থেকে যেন আমাদের দলে সক্রিয় দেখি!'
মাস্তানি স্টাইলে কথাগুলো বলে হলুদ দাঁত বের করে ক্রুর হাসি দিল আরমান। স্কুলে নিজের কর্তৃত্ব খাটাতে দুর্বল ছাত্রদের সাথে সে প্রায়ই এরকম করে। ঝগড়াঝাঁটির আগাম প্রস্তুতি হিসেবে একটি ক্ষুর তার সাথে থাকে সবসময়। ইতোমধ্যে পুরো স্কুলে 'ক্ষুর আরমান' হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছেও সে।
- 'আসলে...'
আমতা আমতা করছে রাজু।
- 'দ্যাখ রাজু! আসলে-ফাসলে কিছু বুঝি না। যা বলছি তাই যেন হয়।' মুখটা কাঁচির মতো বাঁকা করে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে চলে গেল আরমান।
স্কুলের পেছনে সজনেগাছের ছায়ায় বসে চিনে বাদাম চিবুচ্ছিল রাজু। বিরতির সময়টুকু কাটাতে
এ জায়গাটাই তার পছন্দ। গাছের পরই শুরু বিস্তৃত ফসলি জমির। স্কুলের সামনেপেছনে সারিবদ্ধ গাছগাছালি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ ক্যানভাসে আঁকা খেলাঘরের ছবি। তাছাড়া, ওখানের বাতাস স্বচ্ছ, নির্মল।
এ জায়গাটাই তার পছন্দ। গাছের পরই শুরু বিস্তৃত ফসলি জমির। স্কুলের সামনেপেছনে সারিবদ্ধ গাছগাছালি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ ক্যানভাসে আঁকা খেলাঘরের ছবি। তাছাড়া, ওখানের বাতাস স্বচ্ছ, নির্মল।
ক্লাসের আর কিছু সময় বাকি। রাজু উঠতে যাবে, তখনই আরমানের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
ক্লাস নাইন। ষষ্ঠ ক্লাসের শিক্ষক না আসায় ছাত্রদের অনেকে হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত, নেতাগোছের কেউ কেউ তুলনামূলক দুর্বলদের কঠিনভাবে শাসাচ্ছে, অতি উৎসাহীরা করতালির সাথে আগ্রহভরে উপভোগ করছে এই দৃশ্য। রাজু নিজ আসনে উপবিষ্ট। তার চোখ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। হঠাৎ একটি কঙ্কর এসে পড়ল রাজুর মাথায়। কে কঙ্কর ছুঁড়েছে দেখার জন্য যে-ই মাথা তুলেছে, অমনি হো হো করে হেসে ওঠল আরমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। বিষম ব্যথায় টনটন করছে রাজুর মাথা। দুঃখের সাথে সাথে ক্ষোভে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এল; কারো সাথে তো তার কোনোরকম বিরোধ নেই! তবুও ওরা কেন তার সাথে এরকম করে? ওদেরকে মাটিতে পুঁতে ফেলার ইচ্ছে হল তার, কিন্তু বাস্তবতার মাটি খুব শক্ত; চাইলেই তার পক্ষে সম্ভব না!
সে উঠে গিয়ে হেডস্যারকে ঘটনা সবিস্তারে জানাল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না।
রাতে রাজুর মাথায় কঙ্করের আঘাত করা অংশ উঁকি দিতে গিয়ে ধরা খেল তার মায়ের চোখে। মায়ের সীমাহীন পীড়াপীড়িতে সমস্ত ঘটনা মাকে খুলে বলল রাজু। নীরবে চোখের পানি ফেলে শুধু বললেন- 'বাপরে, করার কিছুই নেই। সবুর কর, অসহায়ের কেউ না থাকলেও আল্লাহ আছেন।'
(২)
এক সপ্তাহ পর।
প্রথম পিরিয়ড। ক্লাস নিচ্ছেন মুজিবুর স্যার। সদা হাসি হাসি মুখ স্যারের। দেখলে মনে হয়, এইমাত্র তিনি মজার কোনো কথা শুনেছেন। শীত কি গ্রীষ্ম, সবসময়ই গলায় একটা খয়েরি রঙের মাফলার ঝোলানো থাকে।
নতুন পড়া শুরু করার পূর্বে আগের দিনের পড়া লেখানো স্যারের অভ্যেস। কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন- 'গতকালের পাঠ থেকে যার যতোটুকু ইচ্ছে লিখে দেখাও, তবে যেন দশ লাইনের কম না হয়।'
পুরো স্কুলে সাকুল্যে দুটি গ্রুপ। একটি আরমান গ্রুপ অপরটি রঘু গ্রুপ। উভয় গ্রুপের সদস্যরাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ভালো ভালো ছাত্রদের নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। কেউ রাজি না হলে তার উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়্গ। উভয় গ্রুপের নেতাই ক্লাস নাইনের ছাত্র। এমন একটি সপ্তাহ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে সপ্তাহে উভয় গ্রুপের কথা কাটাকাটি হয়নি। ভালো ছাত্র বলে উভয় গ্রুপের মনোযোগই রাজুকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত। দলের সাধারণ সদস্যদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় দলের বার্তা নিয়ে এল স্বয়ং রঘু।
'কেউ কাউকে দেখাবি না, যে দেখাবি তার পিঠের ছাল তুলে ফেলব।'
শান্ত অথচ কঠোর গলায় বললেন স্যার।
স্যারের কথায় হতাশা ছায়া ফেলল রঘুর চোখেমুখে। কিছুটা অনুতপ্ত হল, কেন যে প্রথম ঘণ্টাতেই রাজুর পেছনে অর্থাৎ দ্বিতীয় বেঞ্চে এসে বসল!
তবে, এই ভেবে মনকে প্রবোধ দিল, রাজু তো বরাবরই স্টার মার্ক পায় এবং সে তো রাজুর পেছনেই। দেখে দেখে লেখার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না : চাই কি রাজুও তো দেখাতে পারে!
নীতিবান বলে স্যারের আলাদা একটা পরিচয় সম্পর্কে স্কুলের সবাই অবগত। এ-ও জানে, স্যার যা বলেন, তাই করেন।
স্যারের কঠোর কণ্ঠ মাথায় রেখে রঘুর দেখানোর কয়েকটা প্রস্তাব নাকচ করে দিল রাজু। সতর্কবাণী শুনিয়ে সাময়িকের জন্য স্যার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হতমান রঘু স্যারের অন্যমনস্কের সুযোগ ভালোভাবেই নিয়ে রাজুর তলপেটে বসাল এক ঘুষি। ব্যথার তীব্রতা সইতে না পেরে ডেস্কের উপরেই লুটিয়ে পড়ল রাজু।
'কী হয়েছে? কী হয়েছে?' বলে রাজুর চারপাশে জড়ো হল সবাই। অবস্থা বেধড়ক দেখে রঘু শাটপাট দৌড়ে পালাল।
ভোজবাজির মতো ঘটে গেল সব। ঘটনার় বিমূঢ়তা কাটিয়ে ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় নিল সবাই। রাজুর কাছ থেকে সবকিছু জেনে সালিশ ডাকলেন মুজিবুর স্যার।
ন্যায়বিচারের বদলে হুমকির মুখে পড়লেন স্যার এবং প্রতাপশালীর ছেলে বলে পার পেয়ে গেল রঘু।
(৩)
ভোর। পাখির পালকের মতো খসে গেছে রাতের আঁধার। ফজরের নামায আদায় করে খোশগল্পে মেতে হাঁটছিলেন মুরব্বি গোছের কয়েকজন মুসল্লি। গ্রামের বড় দিঘির পাশে এসে রসগোল্লার মতো হয়ে গেল তাদের চোখ। দিঘির একপাশে স্থির পড়ে আছে রঘু। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে। পরিবেশ পাল্টে গেল। শোকের মাতম পড়ল রঘুর বাড়িতে। ছেলের খুনে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো হয়ে গেলেন রঘুর বাবা। রঘু গ্রুপের ছেলেরা অজ্ঞাত খুনির চৌদ্দ গোষ্ঠীকে নরকে পাঠানোর লক্ষ্যে তৎপর হয়ে উঠল।
শোকের 'আমেজ' বইছে গোটা গ্রামে। কে জানি একজন বলে উঠল- 'ক্ষুর আরমান'কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা গ্রাম লেগে গেল তার সন্ধানে। চারদিকে যখন সবাই মরিয়া হয়ে আরমানকে খুঁজছে আর রঘুর মতো পরিণতি নিয়ে শঙ্কা করছে, ঠিক তখন তাদের সামনে এসে পড়ল রাজু। হাতে চাপাতি। মনুষ্য রক্ত ঝরছে সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
.গল্প : বিপরীত যাত্রা
লিখেছেন : বদর উদ্দীন রব্বানী

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন