শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

অভিশপ্ত দিনমজুর

সালাহ উদ্দীন আলভী


চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট। রিয়াজুদ্দীন বাজার ওখানখার মার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গা। অামার নিজের এক অাপন মানুষের তরকারি ব্যবসা ওখানটায়। তিনি প্রায়ই অামাকে নিয়ে যেতেন। কখনো একাকিত্বকে এড়াতে। কখনো বা
সাহয্যের জন্যে। ভালোই লাগতো। চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা যেমন মজাদার তেমনি তাদের অাচার অাচরণ ভারি মিষ্টি। অনেক অাপনজন অামার অাছেন ওখানে। তখনো অনেক প্রিয়জন ছিলেন। এরা এতো সহজে মানুষের ভেতরে কী করে ঢুকে যান সেটা দেখে বারবার অাশ্চর্য হয়েছি। চট্টগ্রাম ঘুরে দেখার লালসায়ই প্রতিদিন নিউ মার্কেট, রিয়াজুদ্দীন বাজার ওসবে যেতাম। খুব অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পেতাম। ওখানে অনেককিছুই অদ্ভুত। রেস্টুরেন্টগুলো অদ্ভুত। চোরাই মার্কেট অদ্ভুত। অারো অদ্ভুত হিজড়া মানুষগুলো।
একবার এক গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো এক রেস্টুরেন্টের দিকে। সাইনবোর্ডে লেখা "সুন্নতী হোটেল"। কৌতুহল বশত ভেতরে গেলাম। ইচ্ছে ছিলো, সুন্নতী পরিবেশ পেলে পেটটাকে একটু খাতির করে নিয়ে অাসবো। ভেতরে গিয়ে দেখি দিব্যি চেয়ার-টেবিলে বসে ভোজন চলছে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলাম। অার নিজেকে কেমন কমেডিয়ান মনে হতে লাগলো।
চোরাই মার্কেট হলো, অাপনি খুব সস্তায় মোবাইল, ক্যামেরা কিংবা মেশিনারি জিনিস যা ইচ্ছা ওখান থেকে কিনতে পারবেন-এই নিশ্চয়তা দেয়া যায়। কিন্তু বাসায় নিয়ে অাসতে পারবেন- এর কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত। যে দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিনেছেন, খুব সম্ভব ওখানেই অাপনার পেছনে চোর মহাশয় অপেক্ষা করতে থাকবেন। মালটা অাপনার পকেটে ঢোকা মানে ওনারই পকেটে ঢোকা; এটা ওনার অাত্মবিশ্বাস।

হিজড়াদের কথা নাই বললাম, লজ্জায় হাসতে পারিনা এদের কথা মনে হলে। যারা জানেন, তাদের সাথে একটু হাসি ভাগ করে নিয়েছি মনে করে হেসে নিন।
যা কিছুর কথা বললাম পূর্বে, তা খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ জিনিস। এখন যা বলবো তা সাধারণ, কিন্তু স্বাভাবিক না। অথবা শিক্ষিতের জন্যে 'সাধারণ' 'স্বাভাবিক' কোনোটাই না। অামাদের সমাজে অশিক্ষা বেড়েছে বলেই অামরা অমানুষ হচ্ছি, এটা জলজ্যান্ত সত্য বাণী। ঐদিনই এর প্রমাণ পেয়েছিলাম। 
খুব ব্যস্ত তরকারি অাড়তের এলাকাটা। অামি হাতে বেশ কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে মেইনরোডে বেরুবার জন্যে এগুচ্ছি। প্রায় বেরিয়েও পড়েছি। সামনে চোখ ফেলে দেখি ত্রিমুখীর মধ্যখানে, যেখানে গলিটা গিয়ে মেইনরোডে মিশেছে ওখানটায় মানুষের অনেক বড় জটলা। এতো ঝামেলার মধ্যে তাও এতোগুলো সদাইপাতি হাতে ওদিকে মনোযোগী হতে চাইলামনা। প্রায় পাশ কেটে চলেই যাচ্ছি, তখন হঠাৎ মনের অজান্তে গিয়ে চোখ পড়লো জটলার মধ্যখানে রিক্সার ড্রাইভিং সীটে বসা একজন মনুষের মুখে। তাকে দেখতে পেয়েছি, কারণ তিনি উঁচুতে, রিক্সার সীটে। পাঠক বিশ্বাস করুন অার নাই করুন, অামার যতোদিন তাঁকে মনে পড়েছে ততোদিন এবং এই এখন লেখার সময় অামার চোখ জলে ভরে গেছে। ভেতরটায় অাকাশভাঙার মতো শব্দে কে জানি চিৎকার দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ভদ্রলোকের চোখমুখ লাল। গালে থাপ্পড়ের চিহ্ন। কালো চেহারার এই মানুষটার বয়স ঠিক অামার বাবার বয়সের মতো মনে হয়েছে। মুখে দাড়ি নেই বলে বার্ধক্য একটু অাড়ালে অাছে। লোকটির চোখ দিয়ে দেদারসে পানি পড়ছে। মনটা কেমন মোচড় দিয়ে  উঠলো। বড্ড কান্না পাচ্ছিলো তখন। ভুলে গেলাম হাতের ভারি সদাইপাতিগুলোর কথা। সামনে এগুলাম। দেখি, তিনি রিক্সার হাতলে ধরে সামনে দাঁড়ানো তাঁর ছেলের বয়েসী এক ছেলের দিকে ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে কাঁদছেন অার ঐ ছেলেটারই হাতে থাপ্পড় খেয়ে চলেছেন অনবরত। ছেলেটি অকথ্য ভাষায় মা বাবা তোলে গালি দিচ্ছে অার একটু পর পর জোরসে থাপ্পড় বসিয়ে দিচ্ছে  তাঁর চওড়া গালদেশে। চেহারা অার বেশভূষা দেখে মনে হয়েছে কোনো উচ্চমধ্যবিত্তের ঘর থেকে অাসা ছেলে। অাক্ষরিক শিক্ষা অাছে, কিন্তু চরিত্রের শিক্ষাটাই নেই মনে হয়। ধনী পরিবারের অভিভাবকরা এই একটা জায়গায় ভুল করেন। তাঁরা তাঁদের সন্তানগুলোকে নাচের ক্লাসে, গানের ক্লাসে কিংবা অার্টের ক্লাসে পাঠান খুব রুটিন মেনে। কিন্তু এতোসবের দৌড়প্যাঁচে পড়ে মানবতার ক্লাসে পাঠাবার কথা দিব্যি ভুলে বসে যান। অবাক লাগলো, শতাধিক মানুষ ঐ জটলায়। কিন্তু কেউ ছেলেটাকে বললোনা ঐ মুরুব্বি লোকটাকে না মারতে। কেউ এগিয়ে এলোনা প্রতিবাদ করতে। অামি সামনে এগুতেই পারলামনা মানুষের জটলার ভেতরে ব্যাগগুলো নিয়ে। নাহলে অন্তত ছেলেটার পায়ে ধরে বলতাম, ভাই! অামার মনে হচ্ছে তুমি অামার বাবাকে মারছো, দয়া করে তাঁকে বাদ দিয়ে এরপরের থাপ্পড়গুলো অামার গালে বসিয়ে দাও। 
লম্বা দেহবিশিষ্ট মেদহীন শরীরের এই রিক্সাচালক মানুষটিকে দেখলে বোঝাই যায়, শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। কিন্তু তিনি ধরে নিয়েছেন, তাঁর থাপ্পড় খাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। কারণ দিন শেষে তাঁকে দু'কেজি চাল নিয়ে বস্তিতে ফিরতে হবে। সেখানে ক্ষুধার অাগুনে পুড়ছে কয়েকটি তাজা অথচ টিনটনে প্রাণ। এখানকার হট্টগোলে ফেঁসে বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলে তাঁকে সন্ধ্যাবেলা বাসায় না, যেতে হবে জেলহাজতে। এটা উচিৎ নয়। ছেলেটা গজগজ করতে করতে চলে গেলো। লোকটির পাশে যাওয়ার মতো মন মানসিকতা অামার অার ছিলোনা। কেবলই কান্না পাচ্ছিলো। ব্যথাটনটনে মন নিয়ে অাস্তে অাস্তে বেরিয়ে চলে অাসলাম। বিবেকের অাইন নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত পৃথিবীটাকে তখন প্রশ্ন করতে মন চাইলো,
 ‘‘কবে শেষ হবে তোমার থিসিস? কবে গামছাওয়ালারা তাদের গালে ছুড়ে দেয়া থাপ্পড়ের বদলে কান্না নয়, ফিরিয়ে দিতে পারবে অারেকটি থাপ্পড়, বলতে পারো? কবে অভিশপ্ত এই দিনমজুরগুলো তোমার চোখে প্রদর্শিত হবে জাতির সৌভাগ্যের তিলক হয়ে, বলবে?’’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...