শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

ছোট গল্প

ছাঈদুর রাহমান
কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আগের রাত। ভেতরে কিছুটা টেনশন কাজ করছে। রিলাক্স হওয়ার জন্য ইকবাল ভাই আর আমি কাছের কোন একটি রেস্তোরায় গেলাম চা পান করতে। প্রায় রাতেই এ রেস্তোরায় চায়ের টানে আসি। রাত বেশি হয় নি, ঘড়ির কাটা সবেমাত্র ১০ এ ছুঁই ছুঁই করছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও মৃদুমন্দ বাতাসের ফলে কিছুক্ষণ আগের ভ্যাপসা গরম'টা এখন আর নেই, বেশ আরাম দায়ক অনুভূতি!
চায়ের অর্ডার দিলাম। রেস্তোরা একেবারে ফাঁকা, খরিদদার বলতে আমরা দু'জনই। ইলেক্ট্রিসিটি নেই সেই কখন থেকে, অাসার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। দোকানের এক কোণে অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া জ্বলন্ত মোমবাতি'টা বাতাসের সাথে রীতিমতো লড়াই করে চলছে, নিজের অস্তিত্ব'টুকু টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মোমবাতির টিমটিমে আলো পুরো রেস্তোরাকে আলোকিত করতে পারছে না, ফলে সৃষ্টি হয়েছে আলো-আঁধারির খেলা। মাঝে সাঝে তীব্র বিদ্যুৎ চমক রাতের অাঁধার কে চিরে দিয়ে আবার কোথাও যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে।
হোটেলবয় দু'কাপ চা আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। চা'টা বেশ হয়েছে, রং দেখেই বুঝা যায়। ধুমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান বিষয়ে কথা চলল দু'জনের মাঝে। কথা-বার্তার এক ফাঁকে খেয়াল করলাম, দোকানে একজন পাগলের আগমন ঘটেছে। এসেই আমাদের সম্মুখের চেয়ার'টায় ধপাস করে বসে পরল। শরীরের অবস্থা জীর্ণ-শীর্ণ, গায়ে ময়লা-ছেড়া পোষাক, মুখে অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে উঠা দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। মাথার উষ্কুখুষ্কু চুলগুলোতে চিঁড়ুনির ছোঁয়া লাগেনি বহুদিন হয়েছে। হাতে নানা জায়গায় টেপ পরা সিলভারের থালা।
দোকানি তাকে প্লেটে খাবার দিতে চাইলে সে রাগে গজগজ করে উঠে বলল, আমার থালাতেই খাবার দাও, খাবার সাথে করে নিয়ে যাব, আমাকে তাড়া-তাড়ি ট্রেন ধরতে হবে, ট্রেন মিস করলে কিন্তু আখাওড়া পৌঁছুতে পারব না, হ্যান ত্যান আরও অনেক কিছু। লোকটা বার বার দেয়ালের দিকে তাকাচ্ছে আর বলছে, ঐতো ট্রেন ছেড়ে দিল বলে, আর মাত্র ক'য়েক মিনিট। বুঝতে পারলাম ট্রেন বিষয়ক কোন ব্যাপার নিয়ে সে মাথায় আঘাত পেয়েছে, ফলে সর্বদা ট্রেনের কথাই বলছে। এমনও তো হতে পারে, ছোট বেলায় সে তার বাবা-মা কে এই রেল স্ট্রেশনেই হারিয়ে ফেলেছিল, এক পর্যায়ে পরিবার হারানোর বেদনা থেকেই তার এই মস্তিষ্ক বিক্রিতির সৃষ্টি। লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগলো। এক সময়ের সুস্থ মানুষ'টা এখন পশুর ন্যায় রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। রাস্তাই তার বাড়ি-ঘর,ঠিকানা, সবকিছু। ভিক্ষুকের মতো কারো কাছে হাত পেতে কিছু চাইতেও পারে না, সামনে যা পায় তাই খায়। কি অভিশপ্ত জীবন! আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে এ ধরনের অবস্থা থেকে পানাহ চাই।
চা পর্ব শেষ করে বিল মিটিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরলাম। দেখলাম, পাগল লোকটিও আমাদের কে আগ বাড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে, এক পর্যায়ে অন্ধকার গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই অন্ধকার রাতে লোক'টি কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে কে জানে? কোন মানুষ কি তাদের বাড়িতে লোকটি কে একটু মাথা গুঁজার ঠাঁই দিবে? মনে হয় না। বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। এই বৃষ্টির রাতে কোথাও জায়গা না পেয়ে লোকটি হয় তো কারো বাড়ির আঙিনায় তাদের পালা কুকুর গুলোর সাথে শুয়ে রাত'টা কোন রকম পার করে দেবে। কুকুর গুলোও তাকে কিছু বলবে না, নিজেদের'ই একজন হিসেবে গ্রহন করে নেবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন লেখাগুলো পড়ুন...

      দুশ্চিন্তার চিকিৎসা   মূল: রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি উর্দু: مفتی رشید احمد لدھیانوی ‎‎ জন্মঃ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ মৃত্যু...